মোহাম্মদপুর ডায়েরিস : নগরের গল্প তৈরি হয় মহল্লার কথা দিয়ে

মোহাম্মদপুর ডায়েরিস অনুষ্ঠানে অতিথিরা। শনিবার ঢাকার মোহাম্মদপুরেছবি: আয়োজকদের সৌজন্যে

ঢাকা শহরের ঘনবসতিপূর্ণ মোহাম্মদপুরের চেহারা ষাট বা সত্তরের দশকেও ছিল একেবারে অন্য রকম। এখানকার নূরজাহান রোড থেকে একদিকে নদী আর আরেক পাশে সংসদ ভবন দেখা যেত। তখনকার পাড়া বা মহল্লাকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থাও ছিল আলাদা। ‘মোহাম্মদপুর ডায়েরিস পর্ব এক’–এর আয়োজনে উঠে এল এ কথাগুলো।

শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরের মীর মঞ্জিলে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে বক্তারা স্মৃতিকথায় ডুব দিয়ে শোনালেন সেসব দিনের গল্প। এটি মূলত মানুষের স্মৃতিতে থাকা মহল্লার ইতিহাস সংরক্ষণের প্রয়াস।

শিল্পী ও শিল্প আলোচক শাওন আকন্দ বলেন, মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়িতে অনেক পেশার মানুষ ছিলেন একসময়। এখানে এমনও বাড়ি আছে, যেখান থেকে একদিকে নদী, আরেক দিকে সংসদ ভবন দেখা যেত। তিনি বলেন, মোহাম্মদপুরের বৈচিত্র্যময় অতীত এখনো আছে, তবে তা নানা মাত্রায়।

অনুষ্ঠানের শুরুতে ষাটের দশকে তৈরি মীর মঞ্জিলের সংস্কার নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র দেখানো হয়। দেখা যায়, ষাট বছরের বেশি পুরোনো ভবনটি সংস্কারের সময় এর মূল স্থাপত্যকাঠামো অক্ষত রেখে সংরক্ষণের জন্য ‘আইএবি অ্যাওয়ার্ড ২০২৩’ অর্জন করেছে।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন মাহবুব উর রহমান। নিজের নানা বাড়ি ‘মীর মঞ্জিল’ প্রসঙ্গে তিনি বললেন, আশির দশকে তিনি এ বাড়িতে এক বছর নিয়মিত ছিলেন। তখনকার সংস্কৃতি আর খেলাধুলার আয়োজনগুলো এখন পর্যন্ত স্মৃতিকাতর করে তোলে। তখনকার একটা ফুটবল ম্যাচও ছিল সামাজিক আয়োজনের অংশ।

মোহাম্মদপুর ডায়েরিসের প্রথম পর্বের মূল বক্তা ছিলেন স্থানীয়দের কাছে ‘ইকবাল মামা’ নামে পরিচিত আহমেদ ইকবাল হাসান। ১৯৬৭ সালে মোহাম্মদপুর সরকারি বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেছেন তিনি। পরে ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত নূরজাহান রোডে ছিল তাঁর ‘মামা রেস্তোরাঁ’। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক পরিচালক আহমেদ ইকবাল হাসান বর্তমানে আহমেদ ইকবাল হাসান সিকিউরিটি লিমিটেডের প্রধান। তিনি মনে রেখেছেন অনেক দিন আগের মোহাম্মদপুর, নূরজাহান রোডের গল্প। তিনি বললেন, এই নূরজাহান রোডই যেন ছিল তখন একটা বিশ্ব। সেই নূরজাহান রোডের গল্প দিয়ে মোহাম্মদপুর তথা যেন ঢাকা শহরকে চেনা যায়।

আহমেদ ইকবাল হাসান বলেন, ‘ষাটের দশকে আমরা যখন আসি, তখনো এটার নাম ছিল “বড়াব গ্রাম”। মোহম্মদপুর নামটা তখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুলের সাথে সাথে মোহাম্মদপুরের নামটা প্রতিষ্ঠিত হয়।’ তিনি জানান, জেনেভা ক্যাম্প ছিল খেলার মাঠ। মুক্তিযুদ্ধের পর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নেওয়া অবাঙালি মানুষদের জরুরি ভিত্তিতে পুনর্বাসনের জন্য এই ক্যাম্প তৈরি হয়েছিল খেলার মাঠে। তখন মোহাম্মদপুরের কিশোরেরা অবাক হয়ে দেখেছিল তাদের চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেল তাদের প্রিয় খেলার মাঠ।

আহমেদ ইকবাল হাসান জানান, ১৯৬৫ সালে মোহাম্মদপুরে একটা মাত্র রায়ট হয়েছে। তবে তা বাঙালিরা করেনি। সে দাঙ্গা থামিয়েছিলেনও একজন বিহারি। এখানে হিন্দু–মুসলিমের সম্পর্ক খুব গভীর ছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি। ইকবাল মামার কণ্ঠে আক্ষেপ শোনা যায়, ‘কেউ সংরক্ষণ করতে চায় না। সবাই শুধু হিস্যা চায়।’

আহমেদ ইকবাল হাসান বলেন, ‘সমাজটাকে ভালো করতে হলে দুটি জায়গায় হাত দিতে হবে—সংস্কৃতি ও ক্রীড়া। না হলে সমাজকে এগিয়ে নিতে পারব না। এবারের আন্দোলনেও ২৬ জন প্রাণ হারিয়েছে মোহাম্মদপুরের।’ ২৩ জনের নাম তাঁর কাছেই আছে বলে জানান তিনি।

মুখে মুখে মোহাম্মদপুরের পুরোনো দিনের গল্প বলার পর ছিল প্রশ্নোত্তর পর্ব। পুরোনো দিনের গল্প শুনতে উপস্থিত শ্রোতারা জানতে চেয়েছিলেন বিভিন্ন সড়কের নামকরণ, স্থাপনার নকশা বা এই শহরের রাজনীতি, বসতি স্থাপনের গল্প।