বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবার হত্যার ষড়যন্ত্রের বিষয়টি তদন্ত করতে তদন্ত কমিশন গঠন করা হবে। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, এ জন্য প্রয়োজনীয় আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী খসড়াটি দেখে অনুমোদন দিলে আইনটি পাসের জন্য সংসদে উপস্থাপন করা হবে। এরপর তদন্ত কমিশন গঠন করা হবে।
শোকের মাস আগস্টের প্রথম দিন আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রকাশিত ‘পনেরো আগস্টের নেপথ্য কুশীলব’ বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী তদন্ত কমিশন গঠনের কথাটি জানান। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুলের লেখা গবেষণাভিত্তিক এই বইটি প্রকাশ করেছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শিলালিপি।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব শহীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর ছিল ‘মুক্তির পথে’এবং ‘বাঙালির স্বরাজ ও বঙ্গবন্ধু’ নামের দুটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী।
অনুষ্ঠানের সম্মানিত অতিথি জাতীয় সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের দেশকে বিনাশ করার জন্য ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল। এই দিনটি পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। ঘাতকেরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে তাদের ষড়যন্ত্র ও জিঘাংসাকে বাস্তবায়ন করার জন্য এই দিনটিকেই বেছে নিয়েছিল। কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও বাংলাদেশকে তারা ব্যর্থ করে দিতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন।
অপর সম্মানিত অতিথি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, এই বইটিতে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য–উপাত্ত রয়েছে। যাঁরা নেপথ্যে ছিলেন, তাঁদের সম্পর্কেও অনেক তথ্য রয়েছে। তবে ১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের বিচার হলেও এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে যে ষড়যন্ত্র ছিল, তার বিস্তারিত তদন্তও বিচার করা হয়নি। বহুদিন থেকেই এ জন্য একটি তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি উঠেছে। মন্ত্রী বলেন, প্রথম কাজ ছিল হত্যাকারীদের বিচার করা। প্রথম পর্যায়ে তাদের বিচারের পর দ্বিতীয় ধাপে ষড়যন্ত্রের তদন্ত করার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। তদন্ত কমিশন গঠনের জন্য একটি আইনের প্রয়োজন। সেই আইন হচ্ছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, অবশ্যই তদন্ত কমিশন গঠন করা হবে এবং কারও প্রতি কোনো বিদ্বেষপ্রসূতভাবে নয়, নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের চিহ্নিত করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাপ্রবাসী ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সাজপ্রাপ্ত আসামিদের ফেরত আনা প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী বলেন, সরকার এ নিয়ে সব রকম চেষ্টা চালিয়ে আসছে। আইনগতভাবেই সবকিছু সম্পন্ন হবে।
সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম বলেন, ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। এটি একটি দীর্ঘদিনের সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত আঘাত। তিনি স্মৃতিচারণা করে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়েই ভারতীয় গোয়েন্দা সূত্র প্রবাসী সরকার এবং তিনিসহ বেশ কয়েকজন সেক্টর কমান্ডারকে জানিয়েছিলেন রাজনৈতিক ও সামরিক সদস্যদের একটি অংশ গোপনে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করে পাকিস্তানি ভাবধারায় একটি সরকার গঠনের চেষ্টা করে আসছে। কিন্তু তখন মুক্তিযোদ্ধারা সুসংহত থাকায় তাদের সেই ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড একাত্তরের সেই ষড়যন্ত্রেরই ধারাবাহিকতার ফল। এ জন্য এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের ইতিহাস তুলে ধরা অত্যন্ত জরুরি। তিনি বলেন, সেনানিবাস থেকে ট্যাংক-কামান বের হয়ে এল, কিন্তু কেউ কিছুই জানল না, এটা হতেই পারে না। নেপথ্যের সত্য উদ্ঘাটনের জন্য সঠিক তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। এই বইটিতে ষড়যন্ত্রের নেপথ্যের বিভিন্ন তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে। তবে এ নিয়ে আরও বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বইটি নিয়ে আলোচনায় ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ইতিহাস হলো নগ্ন সত্য। মনজুরুল আহসানের এই বইতে দলমত–নিরপেক্ষ তেমন কিছু নগ্ন সত্যের প্রকাশ আছে। অনেক দালিলিক প্রমাণ ও তথ্য রয়েছে। তবে ষড়যন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ সত্য প্রকাশের জন্য অবশ্যই অবিলম্বে তদন্ত কমিশন গঠন করে প্রাপ্ত তথ্য শ্বেতপত্র আকারে প্রকাশ করা হোক। দেশে হত্যা-ষড়যন্ত্রের রাজনীতি বন্ধ করার জন্যই এটা প্রয়োজন। তিনি বলেন, এটি একটি আকর গ্রন্থ। বইটি নতুন প্রজন্মকে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ও নেপথ্যের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানতে সাহায্য করবে।
অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড অপূরণীয় এবং অমোচনীয় ক্ষতি। এ ঘটনা জাতিকে চিরদিন বেদনার্ত করবে। এর নেপথ্যের অনেক তথ্য আমাদের অজানা। আমাদের দেশে সব তথ্য সব সময় পাওয়াও যায় না। তবে চেষ্টা করলে দেশ-বিদেশে অনুসন্ধান করে অনেক অজানা তথ্য জানা সম্ভব। সে চেষ্টা শুরু হয়েছে। সাংবাদিক মনজুরুল আহসানের এই বই তার দৃষ্টান্ত। তবে ভবিষ্যতে আরও ব্যাপকভাবে এ বিষয়ে অনুসন্ধান হবে। কারণ, ইতিহাসের সত্য কখনো হারিয়ে যায় না।’
লেখক মনজুরুল আহসান বুলবুল তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার হয়েছে। তবে এই হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে আরও অনেকে অনেকভাবে জড়িত ছিলেন। তথ্য–প্রমাণের ভিত্তিতে তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়গুলো বিভিন্নভাবে উঠে এসেছে। এই বইতে নেপথ্যের সেই কুশীলবদের কথা তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডের বিচার ও সেই সময়ের প্রেক্ষাপটও রয়েছে। যাঁরা ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করতে চান, তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য পেতে এই বইটি সহায়ক হবে।’
প্রকাশক জাহিদুল ইসলাম বলেন, নতুন প্রজন্মের কাছে সঠিক ইতিহাস পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ববোধ থেকে তাঁরা এই গবেষণামূলক গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের স্মৃতিচারণা করেন মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের নেতা ইউনুস মিয়া।
শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন বিএফইউজের একাংশের সভাপতি ওমর ফারুক ও ডিইউজের একাংশের সাবেক সভাপতি কুদ্দুছ আফ্রাদ।