মুক্তিযুদ্ধের অনুদ্‌ঘাটিত এক দলিল

১৯৭১ সালের জুলাই মাসে ভারতের শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলন গতিময় করেছিল মুক্তিযুদ্ধকে। এ নিয়ে বই প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন।

প্রথমা প্রকাশনের উদ্যোগে ১৯৭১ : দ্য শিলিগুড়ি কনফারেন্স বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বাঁ থেকে দেবাশীষ মিত্র, মঈদুল হাসান, আমীর-উল ইসলাম ও বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী। গতকাল রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে
ছবি: প্রথম আলো

১৯৭১ সালের মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিদিনের খাবার, ওষুধ জোগাড়সহ বিভিন্ন ধরনের চাহিদা বাড়তে থাকে। একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং তা চালিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও বাড়ছিল। তখন শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া নিয়েও চাপের মুখে পড়ে ভারত সরকার। এ রকম নানা কারণে যুদ্ধের গতি কিছুটা ধীর হতে শুরু করে। এ ছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিয়ে মতান্তর ঘটছিল প্রবাসী সরকারের মধ্যেও। এমন একটি সময়ে অনুষ্ঠিত হয় শিলিগুড়ি সম্মেলন (কনফারেন্স), যেখানে অংশ নিয়েছিলেন প্রবাসী সরকারের সদস্য, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারাসহ ৪০০ জন প্রতিনিধি। এ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া সমন্বয় গতিময় করেছিল মুক্তিযুদ্ধকে।

তবে ১৯৭১ সালের ৫ ও ৬ জুলাই ভারতের শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলন নিয়ে তেমন কোনো তথ্য কোথাও পাওয়া যায় না। যদিও মুক্তিযুদ্ধের সময় দুই দিনের শিলিগুড়ি কনফারেন্স ছিল অনেকটা মোড় ঘোরানোর মতো ঘটনা। অনেক সংকট ও দ্বন্দ্বের সমাধান হয় দুই দিনের ওই সম্মেলনে। অনুদ্‌ঘাটিত সেই সব তথ্য, নথি ও সভার বিবরণ নিয়ে প্রথমা প্রকাশন বের করেছে ১৯৭১: দ্য শিলিগুড়ি কনফারেন্স, অ্যান আনটোল্ড স্টোরি অব দ্য লিবারেশন ওয়ার বইটি। গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর একটি হোটেলে হয়ে গেল এই বইয়ের প্রকাশনা উৎসব, যেখানে হাজির ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সেই সব দিনের বিভিন্ন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা। আরও ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, গবেষক, লেখক ও শিল্পী–সাহিত্যিকেরা।

শিলিগুড়ি কনফারেন্সের প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার অজিত কুমার মিত্র, যিনি এ কে মিত্র নামে পরিচিত। তিনি আর তাঁর দুই সহযোগী মিলে শিলিগুড়ি কনফারেন্সে কথা বলেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, প্রবাসী সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে। তাঁদের সঙ্গে আলোচনার পর এ কে মিত্র ও তাঁর দুই সহযোগী মিলে তৈরি করেন একটি দলিল। সেই দলিলের কথা এত দিন আড়ালেই ছিল।

সংগীত পরিবেশন করছেন ওয়ার্দা আশরাফ
ছবি: প্রথম আলো

এ কে মিত্র মারা যান ২০০৪ সালে। তাঁর মৃত্যুর এক যুগের বেশি সময় পর পুরোনো কাগজপত্র খুঁজতে গিয়ে সেই দলিল বা প্রতিবেদন খুঁজে পান তাঁর ছেলে দেবাশীষ মিত্র। প্রথমা থেকে প্রকাশিত এ বইয়ের প্রকাশনা উৎসব উপলক্ষে বাংলাদেশে এসেছেন দেবাশীষ মিত্র। দলিল কীভাবে হাতে পেলেন—সেই গল্প বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে শুনিয়েছেন তিনি। আরও জানান ‘জয় বাংলা’ ঐতিহ্যটি প্রজন্মের হাত ধরে এখনো কীভাবে অটুট রয়েছে, সে কথাও। তাঁর কথায় উঠে আসে পূর্বসূরিদের অর্জন পরবর্তী প্রজন্মের জানা থাকা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, সেটিও। শিলিগুড়ি কনফারেন্সের দলিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেরই এক সংযোজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে সামনে আরও অনেক কাজের সুযোগ রয়েছে।

দেবাশীষ মিত্রের বক্তব্যের সমর্থন করে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী অনুষ্ঠানে বলেন, একটি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঠিক ইতিহাস পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা জরুরি। সে কাজেরই একটি অংশ ১৯৭১: দ্য শিলিগুড়ি কনফারেন্স বইটি। এ নথিপত্র ভারত থেকে প্রথমার কাছে পৌঁছে দিতে সহযোগিতা করতে পেরে আনন্দিত তিনি।

ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত ১১৯ পৃষ্ঠার এই বইয়ে স্থান পেয়েছে সে সময়ের কাজের পরিকল্পনা, প্রথম গোপন বৈঠকের বর্ণনা। এর সঙ্গে রয়েছে আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরীর বক্তব্য, লেফটেন্যান্ট কর্নেল কে এ মজুমদার এবং ক্যাপ্টেন এ ডি সার্ভের দেওয়া প্রতিবেদন।

বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিজের অভিজ্ঞতার কথা শ্রোতাদের শোনান লেখক মঈদুল হাসান। সে সময় তিনি প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের পক্ষ থেকে ভারত সরকারের কর্মকর্তা, বিদেশি কূটনীতিক ও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে যোগাযোগের কাজটি করতেন। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার নানা পর্বের তথ্য দিয়েছেন তিনি। দেবাশীষ মিত্রের মতো তাঁর বক্তব্যেও উঠে এল মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকারের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও নেতৃত্বের কথা। মঈদুল হাসান বলেন, মুক্তিযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে অব্যবস্থাপনার কারণে অনেক দলিল ও নথিপত্র হারিয়ে গেছে। তবে লুপ্ত সেই ইতিহাসের মধ্যে শিলিগুড়ি কনফারেন্স একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

বইটি নিয়ে কথা বলেন বিশিষ্ট আইনজীবী আমীর–উল ইসলাম, যিনি নিজেও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম একজন সংগঠক। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের সেই সময়ে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের প্রতিদিনের সংকটের একটি সারমর্মই ছিল শিলিগুড়ি কনফারেন্স। আর সেই ঐতিহাসিক তথ্য নথিভুক্ত হওয়ার কারণেই বইটি গুরুত্বপূর্ণ।

গতকালের প্রকাশনা অনুষ্ঠানের শুরু হয় ওয়ার্দা আশরাফের কণ্ঠে জোয়ান বায়েজের গাওয়া ‘দ্য স্টোরি অব বাংলাদেশ’ গানটি দিয়ে। ১৯৭১ সালে ‘দ্য স্টোরি অব বাংলাদেশ’ নামে গানটি লিখে নিজেই সুর করে গেয়েছিলেন জোয়ান বায়েজ।

১৯৭১: দ্য শিলিগুড়ি কনফারেন্স বইটি সম্পাদনার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান জানান, হয়তো সব তথ্য নেই, কিন্তু এই বইয়ে শিলিগুড়ি কনফারেন্সের গুরুত্বপূর্ণ অংশের পুরোটাই সন্নিবেশিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, সেনাপ্রধান কর্নেল মুহম্মদ আতাউল গনি ওসমানীর প্রতি ভারত সরকারের শ্রদ্ধা কতটা গভীর ছিল, সে প্রমাণ রয়েছে বইয়ে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে থাকবে বইটি। এ নিয়ে কেউ আরও গবেষণামূলক কাজ করতে চাইলে তাঁর জন্যও প্রয়োজন হবে ১৯৭১: দ্য শিলিগুড়ি কনফারেন্স বইটি।