ঢাকার রাস্তায় অটোরিকশার মিটারের কথা ভুলতে বসেছে সবাই
মালিকেরা নির্ধারিত জমার চেয়ে বেশি নিচ্ছেন। যাত্রীদের জিম্মি করে চুক্তিতে চালাচ্ছেন চালকেরা। অনিয়ম বন্ধে তৎপরতা নেই সরকারি সংস্থাগুলোর।
রাজধানীর মিরপুরের দক্ষিণ পাইকপাড়ার বাসা থেকে মগবাজার দিলু রোড যাওয়ার জন্য গত বৃহস্পতিবার সকালে সিএনজিচালিত অটোরিকশা খুঁজছিলেন সাহানা সাত্তার। কয়েকটা অটোরিকশার চালক মগবাজার যেতে রাজি হলেন না। একজন ভাড়া চাইলেন ৩৫০ টাকা। শেষ পর্যন্ত ৩০০ টাকায় রফা করে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন তিনি।
পাইকপাড়া থেকে দিলু রোডের দূরত্ব ৭ দশমিক ৮ কিলোমিটার। সরকার নির্ধারিত হিসাবে ২০ মিনিট যানজটসহ এই দূরত্বের ভাড়া আসে ১৯০ টাকার মতো। অটোরিকশাচালক মিটারে না গিয়ে নিজের মতো ভাড়া চাওয়ায় যাত্রীকে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে ১১০ টাকা বেশি দিতে হয়েছে।
সিএনজি অটোরিকশার এই ভাড়ানৈরাজ্য চলছে পুরো ঢাকা শহরেই। যাত্রীর ইচ্ছেমতো গন্তব্যে মিটার অনুযায়ী অটোরিকশা চলাচল করবে, এটাই নিয়ম। অথচ রাজধানীতে যাত্রীদের রীতিমতো জিম্মি করে রেখেছেন চালকেরা। তাঁদের গন্তব্য পছন্দ না হলে যাত্রী তুলছেন না। যাত্রী তুললেও সেটা মিটারে নির্ধারিত ভাড়ায় নয়, চুক্তিতে বেশি টাকায়। এই নৈরাজ্য ঠেকাতে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর কোনো তৎপরতা নেই। এ কারণে হয়রানির এই চক্র থেকে যাত্রীরা মুক্তি পাচ্ছেন না।
চালকদের আরও অভিযোগ, রাজধানীতে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের জন্য নিবন্ধিত ‘প্রাইভেট’ অটোরিকশাগুলো চুক্তিতে যাত্রী আনা-নেওয়া করে। এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় ট্র্যাফিক পুলিশের সদস্যদের টাকা দিতে হয়, সেটাকে বাড়তি খরচ বলে জানান তাঁরা।
সড়ক পরিবহন আইনের ৩৫ (৩) ধারায় বলা আছে, অটোরিকশাচালক রুট পারমিট এলাকার ভেতরে যেকোনো গন্তব্যে মিটারে যেতে বাধ্য থাকবেন। মিটারে প্রদর্শিত ভাড়ার অতিরিক্ত দাবি বা আদায় করতে পারবেন না। আইনে এই ধারা লঙ্ঘন করলে শাস্তি হিসেবে অনধিক ছয় মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের কথা বলা হয়েছে।
মিটারে না চলার বিষয়ে অটোরিকশার চালকদের বক্তব্য হলো, সর্বশেষ ৮ বছর আগে সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। এ সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসহ জীবনযাত্রার খরচ অনেক বেড়ে গেছে। মালিকেরা সরকার নির্ধারিত জমার চেয়ে বেশি টাকা নিচ্ছেন। চালকদের আরও অভিযোগ, রাজধানীতে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের জন্য নিবন্ধিত ‘প্রাইভেট’ অটোরিকশাগুলো চুক্তিতে যাত্রী আনা-নেওয়া করে। এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় ট্র্যাফিক পুলিশের সদস্যদের টাকা দিতে হয়, সেটাকে বাড়তি খরচ বলে জানান তাঁরা।
মালিকেরা এখন জমা বেশি নিচ্ছেন, এটা গোপন কিছু নয়। পুলিশ, বিআরটিএ সবাই জানে। ১ হাজার ১০০ টাকার নিচে জমা নিলে অটোরিকশা চালানো সম্ভব নয়। গাড়ির যন্ত্রাংশসহ জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে দুই-তিন গুণ।ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি বরকতুল্লাহ
রাজধানীর বাংলামোটর মোড়ে যাত্রীর অপেক্ষায় বসে ছিলেন অটোরিকশাচালক বেলায়েত হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মালিককে জমা দিতে হয় ১ হাজার ১০০ টাকা। গ্যাস খরচ আছে ৪০০ টাকা। নিজের খাওয়া ও অন্যান্য খরচ আছে ৩০০ টাকা। এই ১ হাজার ৮০০ টাকা খরচ তোলার পরে আয়ের কথা। মিটারে চালালে দিন শেষে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার বেশি থাকে না। বাধ্য হয়েই চুক্তিতে চালাতে হয়।’
ঢাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার বর্তমান ভাড়ার হার ২০১৫ সালের ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর হয়। বর্তমান ভাড়া অনুযায়ী অটোরিকশার প্রথম ২ কিলোমিটারের ভাড়া ৪০ টাকা। পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া ১২ টাকা করে। প্রতি এক মিনিট অপেক্ষার (যাত্রাবিরতি, যানজট ও সিগন্যাল) জন্য ২ টাকা। আর মালিকের জমা ৯০০ টাকা।
বাড়তি জমা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকারও করেন ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি বরকতুল্লাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মালিকেরা এখন জমা বেশি নিচ্ছেন, এটা গোপন কিছু নয়। পুলিশ, বিআরটিএ সবাই জানে। ১ হাজার ১০০ টাকার নিচে জমা নিলে অটোরিকশা চালানো সম্ভব নয়। গাড়ির যন্ত্রাংশসহ জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে দুই-তিন গুণ।’
‘সরকারের কোনো সংস্থা আছে বলে মনে হয় না’
অংশীজনদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে চালক-মালিকেরা মিটারে অটোরিকশা চালানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও তা কার্যকর হয় না। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক) আবু রায়হান মুহাম্মদ সালেহ্ প্রথম আলোকে বলেন, মিটারে না চলা ও অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কোনো যাত্রী অটোরিকশার নম্বর উল্লেখ করে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলে পুলিশের পক্ষে ব্যবস্থা নিতে সুবিধা হয়।
চার বছর আগে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি একটি জরিপ চালিয়ে জানায়, ঢাকা মহানগরীতে চলাচলরত অটোরিকশার ৯৮ শতাংশই চুক্তিতে চলে। যেসব চালক মিটারে চলতেন, তাঁরা ক্ষেত্রবিশেষে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশি দিতে বলতেন। এখন মিটারে চলার ঘটনা একেবারেই বিরল। যাত্রীরাও অটোরিকশার মিটারে না চলাচলের বিষয়টিকে সাধারণ নিয়ম হিসেবে মেনে নিয়েছেন।
রাজধানীর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা সালমান চয়ন প্রথম আলোকে বলেন, ‘শেষ কবে অটোরিকশায় মিটারে চলেছি, মনে করতে পারব না। অটোরিকশায় মিটার নামক কিছু আছে, সেটাই ভুলতে বসেছি। চুক্তিতে গেলে প্রতিবার কমপক্ষে ১০০ টাকা বেশি দিতে হয়। এসব দেখার দায়িত্বে সরকারের কোনো সংস্থা আছে বলে মনে হয় না।’
অটোরিকশার মিটারে চলাচল না করা ও অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া বন্ধে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তৎপরতা চোখে পড়ে না। তবে সংস্থাটির পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। এসব অভিযানে অটোরিকশার মিটারে না চলা, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধকে গুরুত্ব দিতে নির্দেশনা দেওয়া আছে। মিটারে চলছে না—এমন প্রমাণ পাওয়া গেলে জরিমানা করা হচ্ছে। তবে কত মামলা ও জরিমানা করা হয়েছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তিনি জানাতে পারেননি।
ভাড়ায় চলছে ব্যক্তিগত অটোরিকশাও
অটোরিকশা মালিক ও চালকদের অভিযোগ, রাজধানীর সড়কে অবাধে ভাড়ায় চলছে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের জন্য নিবন্ধিত ‘প্রাইভেট’ অটোরিকশা। মালিক সমিতিসহ বিভিন্ন সূত্রের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকায় প্রায় পাঁচ হাজার প্রাইভেট অটোরিকশা ভাড়ায় চলাচল করে। ফলে একই শহরে দুই নিয়ম চলছে। কারও মিটার আছে, কারও মিটারই নেই।
২০১৮ সালে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, প্রাইভেট নিবন্ধিত অটোরিকশা ভাড়ায় চলাচল করতে পারবে না এবং ভাড়ায় চললে তা আটক করতে হবে। কিন্তু সিদ্ধান্তটি মাঠপর্যায়ে কার্যকর হয়নি। বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ছাইরঙা প্রাইভেট সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়ায় চলছে।
দিন শেষে ভুক্তভোগী যাত্রীরা
ঢাকা শহরে ২০০২ সালের শেষ দিক থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল শুরু হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে প্রায় ১৩ হাজার অটোরিকশার নিবন্ধন দেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। পরে ২০১৫ সালে তিন চাকার বাহন মিশুক তুলে দিয়ে আরও দুই হাজার অটোরিকশার অনুমোদন দেওয়া হয়। বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় এখন ভাড়ায়চালিত ১৫ হাজার অনুমোদিত অটোরিকশা রয়েছে। আর ব্যক্তিগত অটোরিকশা আছে ৫ হাজার।
রাজধানীতে অটোরিকশার বেশ চাহিদা থাকলেও দুই দশকের বেশি সময় ধরে নতুন করে তা অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না। ফলে অটোরিকশার মালিকানা বদল নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি চক্র। অটোরিকশাচালক ও মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে একেকটি অটোরিকশার কাগজপত্র পেতে ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের শ্রমিক নেতা, পুলিশ ও বিআরটিএর কর্মকর্তাদের একটা অংশ এই ব্যবসায় জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
অটোরিকশার ভাড়া নিয়ে চলা নৈরাজ্যের পেছনে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর উদাসীনতা দায়ী বলে মনে করেন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অটোরিকশা নিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। মালিকেরা জমা বেশি নেন, চালকেরা জমার টাকা তুলতে চুক্তিতে চালান। দিন শেষে ভুক্তভোগী হন যাত্রীরা। অটোরিকশার ভাড়ানৈরাজ্য বন্ধে সরকারি সংস্থা, নাগরিক সংগঠনসহ অংশীজনদের নিয়ে একটি টাস্কফোর্স করা জরুরি।