আমরা কি মেনে নিচ্ছি এই হত্যাকাণ্ডগুলো

মো. আশিকুর রহমান

ঢাকার বেইলি রোডের একটি সাততলা ‘বাণিজ্যিক’ ভবনে অগ্নিকাণ্ডে এ পর্যন্ত (দুপুর ১২টা, শুক্রবার, ১ মার্চ) ৪৬ জন মানুষ মারা গেছেন, আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অনেকে। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে, সেই আশঙ্কা ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বরাতে জানা যাচ্ছে।

ঠিক পাঁচ দিন আগে অতিথি শিক্ষক হিসেবে আমার প্রতিষ্ঠান বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের একটি কোর্সে শিক্ষার্থীদের দেখাচ্ছিলাম যে বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছরই একটি ভয়ংকর অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটা এখন নিয়মের অংশ হয়ে গিয়েছে। আমার সেই কথাকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রতিষ্ঠিত করল গতকালের এই মৃত্যুযজ্ঞ।

এই মৃত্যুযজ্ঞে এবার শামিল বুয়েটের অন্তত দুজন শিক্ষার্থী, যারা বুয়েটে মাত্র কয়েক মাস আগে তাদের যাত্রা শুরু করেছে। এদের মধ্যে একজন লামিসা ইসলাম, যন্ত্রকৌশল (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং) বিভাগে আমার সরাসরি ছাত্রী। ওদের সেকশনের ছাত্র প্রতিনিধি ছিল লামিসা। একাডেমিক বিভিন্ন কারণে মাঝেমধ্যেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করত। গত বুধবার দুপুরবেলাতেই ওর সঙ্গে কথা হলো একটা ক্লাস-পরীক্ষার পরে। ‘পরীক্ষা কেমন হয়েছে’—আমার এই প্রশ্নের জবাবে মৃদু হাসি দিয়ে জানাল যে তেমন ভালো হয়নি। লামিসার সেই হাসিটাই ওর সঙ্গে আমার শেষ স্মৃতি।  

লামিসা আমাদের নিয়ম না মানা, আইন প্রয়োগ না করা, লোভের জন্য অন্যের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলা, অন্যায়কে দেখেও না দেখার ভান করার এক প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার বলি। ফায়ার সায়েন্স নিয়ে কাজ করার সুবাদে বিভিন্ন ফোরামে অনেকবার বলেছি এসব বিষয় নিয়ে, কারও টনক নড়েনি। কত জায়গায় আমরা বলেছি যে প্রতিটি ভবনের ইভ্যাকুয়েশনের বা মানুষের নির্গমনের পথটি যাতে নিয়ম মেনে করা হয়, সিঁড়িগুলো যাতে সুরক্ষিত থাকে যেন ধোঁয়া বা আগুন সেখানে ঢুকতে না পারে। অন্তত এতটুকু প্রথমে নিশ্চিত করা গেলেও অগ্নিদুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বহু গুণ কমানো যায়। আমরা জানি যে আরও অনেক কিছু করার প্রয়োজন আছে ভবনগুলোর অগ্নিসুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য, কিন্তু প্রথমে অন্তত এতটুকু করি আমরা। সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অন্তত এতটুকু নিশ্চিত করুক, তাদের সেই কার্যকর ক্ষমতা ও ব্যর্থতার দায় দেওয়া হোক।

সেদিনও ক্লাসে বলছিলাম এসব কথা। তার এক সপ্তাহ না যেতেই আমার শিক্ষার্থী আরও অনেক নির্দোষ মানুষের সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডের শিকার হলো। এগুলোর কোনোটাই দুর্ঘটনা নয়, এগুলো আমাদের নির্বিকারত্বের, লোভের, দায়িত্ব এড়ানোর সংস্কৃতির পরিণামে ঘটা একেকটি হত্যাকাণ্ড। আমরা বোধ হয় এসব মেনেই নিয়েছি।

মো. আশিকুর রহমান
অধ্যাপক, যন্ত্রকৌশল বিভাগ, বুয়েট
গবেষক, ফায়ার ডায়নামিকস