আইসিইউতে নুরুন নাহার, বাইরে দুই বোনের কান্না

ডেঙ্গু আক্রান্ত ইসাদ হোসেন (১২) তিন দিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ২১ সেপ্টেম্বর
ছবি: দীপু মালাকার

রাজধানীর ডেমরার চনপাড়ার নুরুন নাহারের (৩০) গত বুধবার জ্বর আসে। তৃতীয় দিন শুক্রবার রক্ত পরীক্ষা করে তাঁর ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। পরদিন তাঁর প্রস্রাব-পায়খানা বন্ধ হয়ে পেট ফুলে যায়। শনিবার রাতেই তাঁকে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।

হাসপাতালে আনার পর স্যালাইন দিলে তাঁর খিঁচুনি শুরু হয়। পরদিন তাঁর জায়গা হয় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। তার পর থেকে এখনো সেখানেই আছেন নুরুন নাহার।

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে আইসিইউর সামনে থাকা নুরুন নাহারের বড় দুই বোন সালমা আক্তার ও নাজমা আক্তারের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।
সালমা আক্তার জানান, নুরুন নাহারের এখনো পায়খানা হয়নি। কৃত্রিম উপায়ে প্রস্রাব করানো হচ্ছে। ছোট্ট বোনটির কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন আরেক বোন নাজমা আক্তার। তিনি বললেন, ‘আমার বোনের পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই। ওর জন্য দোয়া কইরেন।’

এক ভাই ও চার বোনের মধ্যে নুরুন নাহার সবার ছোট। নুরুন ছোট্ট একটি প্রতিষ্ঠানে নিম্ন পদে চাকরি করেন। তাঁকে ছাড়া ভাইবোন সবার বিয়ে হয়েছে। মাকে নিয়ে থাকেন নুরুন নাহার। তাঁদের বাবা মারা গেছেন।

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আজ এই হাসপাতালে ২৫০ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। এর মধ্যে ৯ জন আইসিইউতে, যার সবাই প্রাপ্তবয়স্ক। চলতি মাসে এই হাসপাতালে ২০ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে।

জটিল রোগীদের হাসপাতালে আসতে হবে দ্রুত

এই হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. নিয়াতুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এই হাসপাতালে ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের ৯৫ শতাংশই মারা যাচ্ছেন আইসিইউতে। কারণ, হাসপাতালে এমন সময় রোগীদের আনা হয়, যখন তেমন কিছু করার থাকে না।

নিয়াতুজ্জামান বলেন, আইসিইউতে যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁদের বড় একটা অংশ আসে ঢাকার বাইরের হাসপাতাল থেকে। জটিল অবস্থায় তাঁদের ঢাকায় পাঠানো হয়। কিন্তু ঢাকায় আনার সময় যাত্রাপথে রোগীর সঙ্গে কিছু মেডিকেল সাপোর্ট (অক্সিজেন, স্যালাইন) লাগে। কিন্তু অনেক সময় স্বজনেরা সেসবের ব্যবস্থা না করেই রওনা দেন। রাস্তায় ছয়-আট ঘণ্টা বা তার চেয়ে বেশি সময় লেগে যায়। ততক্ষণে অনেকের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রওনা দিতে হবে। সেই সঙ্গে হাসপাতালে আসার ক্ষেত্রে দেরি করা যাবে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

আইসিইউর সামনে নুরুন নাহারের বড় দুই বোন সালমা আক্তার ও নাজমা আক্তার। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ২১ সেপ্টেম্বর
ছবি: দীপু মালাকার

সরকারি হলেও ব্যয়ে হিমশিম

হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের সাধারণত স্যালাইন দেওয়া হয়। আর জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল দেওয়া হয়। কারও বমি, পেটে ব্যথা বা অন্যান্য উপসর্গ থাকলে তার জন্যও ওষুধ দেওয়া হয়। ফলে অনেকেই মনে করেন, সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসায় রোগীর তেমন খরচ হয় না। কিন্তু বাস্তবতা সব সময় এ রকম থাকে না।

যদি কোনো রোগীর অবস্থা জটিল হয়ে যায়, তখন তাঁকে আইসিইউতে নিতে হয়। তখন খরচ বেড়ে যায়। যেমন আইসিইউতে থাকা নুরুন নাহারের বড় বোন সালমা আক্তার জানান, ২০ হাজার টাকা সুদে নিয়ে তাঁর বোনকে হাসপাতালে ভর্তি করান। আজ দুপুর পর্যন্ত তাঁদের হাতে তিন হাজার টাকা আছে। পরীক্ষা, ওষুধ ও খাবার কেনার পেছনে এসব টাকা খরচ হয়েছে।

আইসিইউতে নেওয়ার প্রয়োজন না পড়লেও ডেঙ্গুর সঙ্গে টাইফয়েড, প্রস্রাবনালিতে সংক্রমণসহ বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা যাচ্ছে। এসব কারণে অনেক ডেঙ্গু রোগীকে দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালে থাকতে হয়। এতেও খরচ বেড়ে যায়।

যাত্রাবাড়ীর গোলাপবাগের সোহানা আক্তার ও কায়েস কবির দম্পতির একমাত্র মেয়ে ১৩ বছরের রোজানা হাসান ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। ১৩-১৪ দিন ধরে তার তীব্র জ্বর। ডেঙ্গুর পাশাপাশি তার প্রস্রাবে সংক্রমণ ধরা পড়েছে।

সোহানা আক্তার জানান, মেয়ে জ্বরের কারণে উঠতে পারে না। সে জন্য মুগদা হাসপাতালের ল্যাব পর্যন্ত মেয়েকে নিয়ে যেতে পারেন না। ফলে এখন পর্যন্ত ১৩টি পরীক্ষা করিয়েছেন, সব কটিই বেসরকারি হাসপাতালে। বেসরকারি হাসপাতাল থেকে এক ব্যক্তি এসে নমুনা নিয়ে যান এবং পরীক্ষার ফলাফল দিয়ে যান। এ জন্য প্রতি পরীক্ষার জন্য ১০০-২০০ টাকা দিতে হয়।

হাসপাতাল থেকে স্যালাইন, বমি ও গ্যাস্ট্রিকের জন্য ওষুধ দিলেও জ্বরের জন্য প্রতিদিন ৫০০ টাকার একটি ইনজেকশন, প্রতিদিন তিনটি করে ৩৫ টাকা দামের পেটের ব্যথার ইনজেকশন তাঁদের বাইরে থেকে কিনতে হয়। ডাব, লেবুর শরবত, আখের শরবত, পেঁপেসহ নানা খাবার কিনতে হয়। তা ছাড়া পরিবারের লোকজনের থাকা, খাওয়া, যাতায়াতসহ নানা ধরনের খরচ আছে। এখন পর্যন্ত তাঁদের ২০-২৫ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে।

সোহানা আক্তার বলেন, ‘তিন হাজার টাকা ঘরে ছিল। সেগুলো নিয়ে হাসপাতালে আসি। তারপর সাড়ে ১৪ হাজার টাকা ধার করেছি। তা ছাড়া আমার স্বামীর প্রতিদিন যা আয় আছে, তা–ও খরচ করছি। আমরা কুলিয়ে উঠতে পারছি না। এদিকে মেয়ের জ্বর, বমি, পেটব্যথাও কমছে না।’

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, শয্যার চেয়ে বেশি রোগী আছে। শয্যায় থাকা রোগীদের জন্য ওষুধ বরাদ্দ থাকে। বাড়তি রোগীদের জন্য ওষুধ থাকে না। কিন্তু ওই নির্দিষ্ট পরিমাণ ওষুধ সবার মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। ফলে কোনো রোগীর দুটি ইনজেকশনের প্রয়োজন থাকলে একটি হাসপাতাল থেকে দেওয়া হচ্ছে, আরেকটি রোগীকে বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে।

ডেঙ্গু আক্রান্ত ছেলে মো. আলীকে (১১) নিয়ে গত রোববার থেকে মুগদা হাসপাতালে আসমা আক্তার। এখন পর্যন্ত ১০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়েছে। আসমা আক্তার বলেন, ‘আজকেও পাঁচটি পরীক্ষা করাতে দিয়েছেন ডাক্তার। এতে দেড় হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আমি টিউশনি করি, স্বামী রিকশা চালায়। আমাদের পক্ষে এত টাকা খরচ করা তো অনেক কঠিন।’

আজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন ২৫০ জন। এর মধ্যে ৫১টি শিশু। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ২১ সেপ্টেম্বর
ছবি: দীপু মালাকার

শয্যার দ্বিগুণ রোগী

মুগদা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মুগদায় মোট শয্যাসংখ্যা ৫০০। কিন্তু আজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৯৭৮ জন রোগী। এর মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২৫০। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৫১টি শিশু।

সরেজমিন দেখা যায়, শিশু ওয়ার্ডে অন্য রোগীদের পাশাপাশি ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ওয়ার্ডের ভেতরে জায়গা না থাকায় বারান্দায় শয্যা পাতা হয়েছে। তাতেও রোগী ধরছে না। ফলে অনেকেই মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
প্রাপ্তবয়স্ক ডেঙ্গু রোগীদের ওয়ার্ডেও প্রায় একই অবস্থা। ওয়ার্ডে জায়গা না থাকায় বারান্দায় শয্যা পাতা হয়েছে।

এই হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) নিয়াতুজ্জামান বলেন, ‘আমরা কোনো রোগীকে ফিরিয়ে দিচ্ছি না। ফলে ওয়ার্ডে জায়গা না হলে তাদের বাইরে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।’