চারতলা ভবনের ‘ছাপরা মসজিদ’

আজিমপুর জামে মসজিদের (ছাপড়া মসজিদ) চারতলা ভবন। ঢাকা, ৪ এপ্রিলছবি: জাহিদুল করিম

ব্রিটিশ আমলে টিনের বেড়ার ওপর টিন পেতে সমতল ছাউনির নেহাত এক ছাপরাঘরই ছিল। সেই থেকেই আজিমপুরের এই মসজিদের নাম হয়েছিল ‘ছাপরা মসজিদ’। তবে এখন তো আর সেই ছাপরা থাকার কথা নয়, নেইও। সেই জায়গায় এখন চারতলা ভবনের ওপরে স্বমহিমায় মাথা উঁচু করে রয়েছে সুদৃশ্য মিনার। তবু নামটি তার বদলায়নি, ‘ছাপরা মসজিদ’ বলেই লোকে এখনো চেনেন আজিমপুর রোড ও শেখ সাহেব বাজার লেনের সংযোগস্থানের মোড়ের এই মসজিকে। মসজিদের ফটকে লেখা নাম ‘আজিমপুর জামে মসজিদ (ছাপড়া মসজিদ)’।

আজিমপুরে ছাপরা মসজিদ ছাড়া আরও কিছু প্রাচীন মসজিদ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো আজিমপুর কবরস্থানের পাশের আজিমপুর মসজিদ। মসজিদে প্রাপ্ত শিলালিপি অনুসারে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৭৪৬ খ্রিষ্টাব্দে। তবে আদি মসজদিটি নেই।

আজিমপুর মসজিদ প্রতিষ্ঠার অল্প কিছুকাল পরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আজিমপুর রোডের দরবার শরিফ মসজিদ। ১৭৭৬ সালে ওই মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দরবার শরিফের সুফি সাধক শাহ সুফি সৈয়দ মুহাম্মদ দায়েম। অষ্টাদশ শতকে ঢাকার এই বুজুর্গ সুফি সাধনার জন্য খুবই প্রসিদ্ধি ও ভক্তদের সম্মান লাভ করেছিলেন। ঢাকার ইতিহাসবিষয়ক বইগুলোতে তাঁর বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। তিনি প্রথমে তাঁর খানকা প্রতিষ্ঠা করেন। পরে এখানে মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই মসজিদ তেমন বড় নয়। একতলা এই মসজিদে এখনো নিয়মিত নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। ছাপরা মসজিদের সঙ্গে এই দায়রা শরিফ মসজিদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলেই এই প্রসঙ্গের অবতারণা।

ছাপরা মসজিদের জায়গাটি আগে ছিল দরবার শরিফেরই মালিকানাধীন। এশিয়াটিক সোসাইটির ঢাকা কোষে বলা হয়েছে, ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে অধ্যয়ন শেষে হোসাইন কাশেমি নামের একজন আলেম ঢাকায় আসেন। তিনি হয়তো আজিমপুর দরবার শরিফের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি এখানে জনসাধারণের জন্য নামাজ আদায় ও দ্বীন শিক্ষার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন। দরবার শরীফ থেকে এ জন্য জায়গা দেওয়া হয়েছিল। সেখানেই পাকা ভিতের ওপরে টিনের বেড়া ও টিনের ছাপরা ছাউনি দিয়ে ১৯৪১ সালে একটি মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল। টিনের ছাপরা ছাউনির জন্যই মসজিদটির নাম হয়েছিল ছাপরা মসজিদ।

ছাপরা মসজিদ প্রথমে সংস্কার করে দোতলা করা হয়েছিল গত শতকের ষাট দশকে বলে ঢাকা কোষে উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর সম্প্রসারণ করে আরও দুই তলা করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে মসজিদে গিয়ে দেখা গেল, চারতলা এই মসজিদের ভেতরে পশ্চিমের দেয়ালের মাঝখানে খিলান আকৃতির একটিই মিহরাব। এই দেয়ালে আর কোনো ছোট মিহরাব বা কুলুঙ্গি নেই। ভেতরে ১২টি কাতারে নামাজ আদায়ের পরিসর। ভেতরের বৃত্তাকার থামগুলোর সঙ্গে হাতের নাগাল মেলে এমন উচ্চতায় চমৎকার নকশার বই রাখার তাক তৈরি করা। সেখানে পবিত্র কোরআন শরিফ, হাদিস ও ধর্মীয় কিতাব রাখা। মসজিদের বারান্দায় তিন কাতারে নামাজের ব্যবস্থা।

মসজিদে প্রবেশের মূল ফটক
ছবি: জাহিদুল করিম

মসজিদের মুয়াজ্জিন মো. ইদ্রিস আলী জানালেন, মসজিদের চারতলায় সাধারণত চার হাজারের মতো মুসল্লি একত্রে নামাজ আদায় করতে পারেন। তবে এখন রমজান মাসের প্রতি জুমায় ছাদে ও সামনের সড়কে আরও অতিরিক্ত প্রায় দুই হাজার মুসল্লি এখানে নামাজ আদায় করেন।  

আজ বৃহস্পতিবার ছাপরা মসজিদের পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবু জাফরের সঙ্গে কথা হলো। তিনি জানালেন, এই মসজিদ প্রায় ১২ কাঠা জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। এ ছাড়া সামনে কিছু দোকান ও একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। সেখান থেকে যে আয় আসে, তাতেই মসজিদে খরচ চলে। তিনি জানালেন, ইদানীং মসজিদে মুসল্লির সংখ্যা অনেক বেড়েছে। মসজিদের অপর পাশেই আজিমপুর সরকারি আবাসনের জন্য অনেক কুড়িতলা ভবন করা হয়েছে। কিন্তু ভেতরে মসজিদ নেই। ফলে আবাসনের বাসিন্দারাও এই মসজিদে নামাজ আদায় করতে আসেন। মুসল্লিদের স্থান সংকুলান হচ্ছে না। কিন্তু এই মসজিদ আর সম্প্রসারণ করাও যাবে না। কমিটির পক্ষ থেকে বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরীক্ষা করে দেখিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ছাপরা মসজিদটির নতুন ভবনটির চরতলার ভিত দিয়েই তৈরি করা হয়েছে। সম্প্রসারণ করতে হলে ভবন ভেঙে নতুন করে করতে হবে। তবে সেটা অনেক ব্যয়সাপেক্ষ বিষয়।

আজিমপুর ছাপরা মসজিদে দ্বীন শিক্ষার ঐতিহ্য ধরে রাখা হয়েছে। পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. আবু জাফর জানালেন, এখানে সেই প্রথম থেকেই হেফজখানা ও নুরানি শিক্ষার ব্যবস্থা চালু আছে। এ ছাড়া তাঁরা প্রায় ২০ বছর থেকে সুবিধাবঞ্চিত ছিন্নমূল শিশুদের বিনা মূল্যে ধর্মীয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। এসব শিশুর শিক্ষাদানের পাশাপাশি পোশাক, শিক্ষা উপকরণ এবং সকালের নাশতাও  দেওয়া হয়। এখন ৮০ জন ছিন্নমূল শিক্ষার্থী রয়েছে। ঈদ উপলক্ষে তাদের প্রত্যেকে নগদ এক হাজার করে টাকা ও চাল, চিনি সেমাই এসব খাদ্যদ্রব্য দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন

নিয়মিত নামাজ ছাড়া প্রতি ঈদে ছাপরা মসজিদে ঈদের জামায়াতও সম্পন্ন হচ্ছে। আজিমপুরে আগে ঈদের জামায়াত অনুষ্ঠিত হতো আজিমপুর কমিউনিটি সেন্টার মাঠে। কিন্তু সেই মাঠে ভবন নির্মাণ করায় ছাপরা মসজিদেই হচ্ছে ঈদের জামায়াত। এবারেও দুই জামায়াত অনুষ্ঠিত হবে এখানে।

আরও পড়ুন