ভরাট-দখলে বিলীন বুড়িগঙ্গার ১৬ কিলোমিটার: গবেষণা

রাজধানীর শুক্রাবাদের দৃকপাঠ ভবনে আজ মঙ্গলবার ‘বুড়িগঙ্গা: নিরুদ্ধ নদী পুনরুদ্ধার’ শীর্ষক গবেষণার ফল উপস্থাপন করা হয়ছবি: প্রথম আলো

বুড়িগঙ্গা নদীর সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য ৪১ কিলোমিটার। এর মধ্যে ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার ওয়াশপুর থেকে হযরতপুর পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার ভরাট, দখল ও প্রবাহশূন্যতার শিকার হয়ে বিলীন হয়ে গেছে। বাকি ২৫ কিলোমিটার প্রবহমান রয়েছে। ‘বুড়িগঙ্গা: নিরুদ্ধ নদী পুনরুদ্ধার’ শীর্ষক এক গবেষণায় এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

আজ মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর শুক্রাবাদে দৃকপাঠ ভবনে গবেষণার ফল তুলে ধরেন প্রধান গবেষক ও নদীরক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকন। ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এই গবেষণা চালানো হয়েছে। গবেষণায় জিপিএস ট্র্যাকিং ও সিএস ম্যাপ ব্যবহার ছাড়াও সরেজমিন তথ্য সংগ্রহ এবং অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে।

যৌথভাবে গবেষণাটি করেছে দৃক পিকচার লাইব্রেরি ও ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি। গবেষণা কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস), রিভারাইন পিপল, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), দ্য ডেইলি স্টার ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি)।

গবেষণায় বলা হয়েছে, ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিকভাবে বুড়িগঙ্গার সম্পূর্ণ অংশ শনাক্ত ও চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। নদীটির প্রকৃত উৎসমুখ ও দৈর্ঘ্য নিয়ে বিভ্রান্তি ছিল। যেমন পানি উন্নয়ন বোর্ড ২৯ কিলোমিটার, বিআইডব্লিউটিএ ৪৫ কিলোমিটার, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ২৯ কিলোমিটার এবং পর্যটন করপোরেশন ২৭ কিলোমিটার হিসেবে বুড়িগঙ্গার দৈর্ঘ্য উল্লেখ করেছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, কেরানীগঞ্জের হযরতপুর ইউনিয়নের ধলেশ্বরী নদী বুড়িগঙ্গার উৎপত্তিস্থল। নদীটি সমাপ্ত হয়েছে কেরানীগঞ্জের কোন্ডা ইউনিয়নের জাজিরা বাজারের কাছে ধলেশ্বরী নদীতে। এর মোট দৈর্ঘ্য ৪১ কিলোমিটার। ১৯১২ সালে যতীন্দ্রমোহন রায়ের লেখা ‘ঢাকার ইতিহাস’ বইয়েও বুড়িগঙ্গার দৈর্ঘ্য ৪১ কিলোমিটার বলে উল্লেখ রয়েছে।

বুড়িগঙ্গার প্রবহমান ২৫ কিলোমিটার অংশে সীমান্ত পিলার আছে এবং শুকনা ১৬ কিলোমিটার অংশে সীমান্ত পিলার নেই বলে জানান শেখ রোকন। তিনি বলেন, বুড়িগঙ্গার ১৬ কিলোমিটার সরকারি নথি থেকে মুছে দেওয়ার মধ্য দিয়ে দখলকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। এই শুকনা অংশে সীমান্ত পিলার দেওয়া হয়নি। পিলার দেওয়া হয়েছে কেবল বুড়িগঙ্গার প্রবহমান অংশে। প্রবহমান অংশে এক হাজারের মতো পিলার পাওয়া গেছে, যার মধ্যে ৭০০ পিলার অক্ষত অবস্থায় নেই।

এক প্রশ্নের জবাবে শেখ রোকন বলেন, বুড়িগঙ্গায় ভরাট–দখলের ১৬ কিলোমিটার অংশ এখন তিন রকম অবস্থায় আছে। প্রথমত, সেখানে অনেক আবাসন প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা তৈরিসহ নানা ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, আরেকটি অংশ ভরাট হয়ে ফসলি জমি হয়েছে। তৃতীয়ত, একটি অংশকে মানুষ খাল হিসেবে চেনে। সেখানে বর্ষায় পানি থাকে, কখনো শুকনা থাকে।

শেখ রোকন বলেন, ১৬ কিলোমিটার অংশ সরকারি দলিলপত্র থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। এই অংশকে বাদ দেওয়ার জন্য বুড়িগঙ্গার উৎপত্তি ধলেশ্বরী হলেও বলা হচ্ছে তুরাগ নদী। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি দলিলের ২০০৫ সালের সংস্করণে এই নদীর দৈর্ঘ্য দেখানো হয় ৪৫ কিলোমিটার। একই দলিলের ২০১১ সালের সংস্করণে বলা হচ্ছে, তা ২৯ কিলোমিটার। এই ১৬ কিলোমিটার বাদ দিয়ে দিচ্ছে।

১৬ কিলোমিটার যেভাবে হারিয়ে গেল

রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক ক্ষমতাকাঠামো কীভাবে বুড়িগঙ্গার দখলপ্রক্রিয়ায় অবদান রেখেছে, তা বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের সংযোগস্থলে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক ও শিল্পস্থাপনাকে ‘কেস স্টাডি’ হিসেবে নিয়ে প্রমাণ করা হয়েছে বলে দাবি করেন গবেষকেরা।

গবেষণায় বলা হয়েছে, মাইশা গ্রুপ নামের একটি বেসরকারি শিল্পগোষ্ঠী বুড়িগঙ্গাসংলগ্ন ভূমি দখল করে ‘আরিশা প্রাইভেট ইকোনমিক জোন’ নামের একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে। সেটিকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ ‘প্রি-কোয়ালিফিকেশন’ সনদ দেয়।

মাইশা গ্রুপ ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিএলসি পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড গঠন করে। আরিশা প্রাইভেট ইকোনমিক জোনে ২০১৭ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ‘সিএলসি ১০৮ মেগাওয়াট এইচএফও ফায়ারড পাওয়ার প্ল্যান্ট’ উদ্বোধন করা হয়। ২০২০ সালে প্রকাশিত জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তথ্যমতে, ৫৪ একরের বেশি নদী ও জলাভূমি দখল করে অর্থনৈতিক অঞ্চলটি নির্মিত।

এই স্থাপনাকে অবৈধ চিহ্নিত করে ২০২০ সালের মার্চ মাসে বিআইডব্লিউটিএ উচ্ছেদ অভিযান চালাতে গেলে শিল্পগোষ্ঠীটির পক্ষ থেকে বাধা দেওয়া হয়। ওই বছরের অক্টোবরে এক শুনানিতে বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক এ কে এম আরিফ উদ্দিন বলেন, ‘সংসদ সদস্যের পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণের কারণে বুড়িগঙ্গা নদীর ১৪ কিলোমিটার মরে গেছে।’

আজকের আয়োজন থেকে বুড়িগঙ্গার ১৬ কিলোমিটার উদ্ধারের দাবি জানানো হয়। গবেষণার সুপারিশে বলা হয়েছে, বুড়িগঙ্গার ভরাট, দখল, শুকিয়ে যাওয়া ও হারিয়ে যাওয়া অংশ থেকে দখলদারদের উচ্ছেদ করে এবং খননের মাধ্যমে প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে।  

যেসব বিষয় উঠে এল

গবেষণায় বুড়িগঙ্গা নদীর বেশকিছু বিষয় উঠে এসেছে। এ গবেষণায় মাঠ জরিপ ও উপগ্রহচিত্র পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বুড়িগঙ্গার অববাহিকার মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে। এতে বুড়িগঙ্গার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত আরও ১২টি নদী বা খাল পাওয়া গেছে।

বুড়িগঙ্গা অববাহিকায় ভূমিরূপের পরিবর্তন বোঝার জন্য এই গবেষণায় ১৯৯০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতি ১০ বছরের ব্যবধানে উপগ্রহচিত্র বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গা অববাহিকায় জলাভূমি ও সবুজ অঞ্চল কমেছে। অন্যদিকে বসতি ও নিম্নভূমি বেড়েছে। এর অর্থ, বুড়িগঙ্গা অববাহিকায় সবুজ অঞ্চল ও জলাভূমি ক্রমবর্ধমান হারে নিম্নভূমিতে পরিণত হয়েছে এবং সেখানে নতুন বসতি স্থাপিত হয়েছে।

জলাভূমিতে জীব বা অণুজীবের জীবনধারণের জন্য প্রতি লিটারে ন্যূনতম ৫ মিলিগ্রাম দ্রবীভূত অক্সিজেন বা ডিও প্রয়োজন হয়। এই গবেষণায় দেখা গেছে, কেবল বর্ষা ও শরৎকালে বুড়িগঙ্গায় সেই নূ৵নতম অক্সিজেন থাকে। বর্ষাকালে সদরঘাটে সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম অক্সিজেন পাওয়া গেছে। বাকি চার ঋতুতে (হেমন্ত, শীত, বসন্ত ও গ্রীষ্মকাল) বুড়িগঙ্গায় জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় নূ৵নতম অক্সিজেন থাকে না। হেমন্তকালে সেটি ১–এর নিচে নেমে আসে।

উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০১৯ সালে বিআইডব্লিউটিএ বুড়িগঙ্গার পানিতে মিলিত হওয়া ভূগর্ভস্থ নালা বা ড্রেন শনাক্ত করে। এ সময় তারা ৬৮টি নালার তথ্য আদালতে উপস্থাপন করে। এই গবেষণায় দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গার দুই তীরে রয়েছে মোট ১০০টি নালা। এর মধ্য ৪৭টি স্লুইসগেটসহ ও ৫৩টি খোলা।

বুড়িগঙ্গার দুই তীর ঘেঁষে ২৫০টি স্থাপনা শনাক্ত করা হয়েছে এই গবেষণায়। যার মধ্যে ১০৮টি কারখানা, ৪৩টি শিপইয়ার্ড, ২৩টি মিল, ২২টি শিল্প স্থাপনা, ১৯টি গুদাম ও ১৭টি ইটভাটা রয়েছে। তবে প্রবেশাধিকার না থাকায় সব স্থাপনার দূষণের মাত্রা ও ধরন এই গবেষণায় পরীক্ষা সম্ভব হয়নি।

‘বুড়িগঙ্গায় প্রাণ ফিরলে তা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে’

গবেষণায় বুড়িগঙ্গা–সম্পর্কিত সরকারের আটটি প্রকল্প পর্যালোচনা করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, সরাসরি বা আংশিকভাবে বুড়িগঙ্গাবিষয়ক আটটি প্রকল্পে গত দুই দশকে অন্তত ৩ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। কিন্তু নদীটি পুনরুদ্ধারে এর প্রভাব দৃশ্যমান নয়।

দখলমুক্ত করে বুড়িগঙ্গায় প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পারলে তা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে মনে করেন বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। এই আয়োজনে আগে ধারণ করা ভিডিও বক্তব্যে তিনি বলেন, এত খরচের পরও বুড়িগঙ্গাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে পারল না সরকার। সরকার যে প্রক্রিয়ায় বুড়িগঙ্গাকে উদ্ধার করতে চায়, সেটি অনেক বেশি ব্যয়বহুল। সেই প্রক্রিয়ায় বুড়িগঙ্গাকে উদ্ধার করা যাবে না; বরং যে প্রক্রিয়াগুলো নদীকে ধ্বংস করছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। বৈষম্যহীনভাবে দখলদারদের উচ্ছেদ করতে হবে।

এই আয়োজনে সভাপ্রধান হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। তিনি বলেন, ‘নদীকে জীবন্ত সত্তা মনে করি। তাহলে জীবন্ত সত্তা যদি মৃত্যুর দিকে যায়, তাহলে আমাদের ভূমিকা কী হবে সেটি ভাবা দরকার।’ এ সময় আরও বক্তব্য দেন বারসিকের পরিচালক পাভেল পার্থ।

গবেষণার সুপারিশে বলা হয়েছে, বুড়িগঙ্গার প্রবহমান অংশের তীরবর্তী দখল উচ্ছেদের পর তা স্থায়ী করতে নজরদারি ও তদারকি প্রয়োজন। নাগরিক ও শিল্পবর্জ্যের উৎসগুলো চিহ্নিত করে বন্ধ করতে হবে, না হয় তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) স্থাপন করতে হবে।