মাঠ আছে, খেলার পরিবেশ নেই

একাধিক মাঠ ঘুরে সিটি করপোরেশনের কোনো তদারকি দেখা যায়নি। অনেক মাঠে বসে মাদকসেবীদের আড্ডা ও অস্থায়ী চা-সিগারেটের দোকান।

লালমাটিয়া এ ব্লকের খেলার মাঠটির (আড়ংয়ের পেছনে) সংস্কারকাজ চলছে। ফেলে রাখা হয়েছে বালু। খেলাধুলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এলাকার শিশু–কিশোরেরাছবি: তানভীর আহাম্মেদ

রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও লালমাটিয়া এলাকায় বেশ কিছু খেলার মাঠ আছে। যেখানে গড়ে ওঠার কথা ছিল শিশু-কিশোরদের খেলার জায়গা, বয়স্ক ব্যক্তিদের হাঁটার পথ আর মানুষের বিনোদনের কেন্দ্র। সেসব আছে ঠিকই। কিন্তু তদারকির অভাবে অনেক মাঠে বসে মাদকসেবীদের আড্ডা ও অস্থায়ী চা-সিগারেটের দোকান।

সম্প্রতি মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোড, টাউন হল মাঠ, সলিমুল্লাহ রোড, তাজমহল রোড, জাকির হোসেন রোড এবং লালমাটিয়ার মাঠগুলো ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেহাল চিত্র টাউন হলের শহীদ পার্ক খেলার মাঠের।

মাঠের প্রধান দুই প্রবেশপথ দখল করে নিয়েছে চা-সিগারেটের অস্থায়ী দোকান। অন্য আরেকটি প্রবেশপথ ঘিরে আসবাবের দোকান। সেদিকে সরু একটি রাস্তা দিয়ে মাঠে ঢোকা যায়। মাঠে নিয়মিত বসে মাদকসেবীদের আড্ডা। মাঠের এক কোণে করা হয়েছে মূত্রত্যাগের খোলা ব্যবস্থা। দুর্গন্ধে হাঁটার উপযোগী পরিবেশ নেই এখানে। তাই আশপাশের লোকজন খুব একটা আসতে চান না। ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, ‘মোহাম্মদপুর শহীদ পার্ক ক্রীড়াচক্র’ নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে চলছে মাঠের তদারকি। লোহার বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা মাঠের এক কোণে শিশুদের খেলার জন্য কিছু রাইডের ব্যবস্থা আছে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মাঠটির দখল মূলত স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির হাতে। তাঁরাই বর্তমানে মাঠের দেখভাল করছেন। সোহরাব হোসেন নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা জানালেন, ৫ আগস্টের আগে এই মাঠে উত্তর সিটি করপোরেশনের কিছুটা তদারকি ছিল। কিন্তু পটপরিবর্তনের পর স্থানীয় বিভিন্ন প্রভাবশালী মাঠের দখল নিয়েছেন। চা-সিগারেটের দোকানও তাঁদের তত্ত্বাবধানে চলে। ভাড়ায় চলানো হয় বিভিন্ন টুর্নামেন্ট। ফলে মাঠের অধিকার হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

পাশে সলিমুল্লাহ রোডের মাঠটিতে প্রতি রোববার অস্থায়ী বাজার বসে। সপ্তাহের বাকি ছয় দিন এই মাঠ উন্মুক্ত থাকে। তবে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে তেমন কোনো উন্নয়নকাজ এই মাঠে দেখা যায়নি। নেই কোনো তত্ত্বাবধান। রোববারের অস্থায়ী বাজারে স্টল বসাতে প্রতি চার হাত জায়গার জন্য হকারদের চাঁদা গুনতে হয় ৫০০ টাকা করে। তবে এই টাকা কারা নেন, সে বিষয়ে ব্যবসায়ীরা কিছু বলতে চাননি।

তাজমহল রোডের মাঠটিতে গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় লোকজনের অনুরোধে সিটি করপোরেশন কর্তৃক কিছু উন্নয়নকাজ করা হচ্ছে। উন্নয়নকাজে নিযুক্ত সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, প্রায় ৬২ লাখ টাকার উন্নয়নকাজ চলছে। এসবের মধ্যে রয়েছে মাঠের অভ্যন্তরে বাউন্ডারি ফ্রেম ফেন্সিং নির্মাণ, বৃক্ষরোপণ, ওয়াশরুম এবং ফটক মেরামত। তবে এই মাঠেও তেমন কোনো তদারকি না থাকায় নিয়মিত মাদকাসক্তদের আনাগোনা থাকে।

মোহাম্মদপুর শহীদ পার্ক খেলার মাঠ
ছবি: প্রথম আলো

মোহাম্মদপুরে শেরশাহ সুরি রোডে একটি ঈদগাহ মাঠ আছে। এই মাঠেরও তেমন কোনো তদারকি নেই। এ ছাড়া জাকির হোসেন রোডে আরেকটি মাঠ আছে। এখানেই সিটি করপোরেশন কিংবা স্থানীয় কমিউনিটির তত্ত্বাবধান দেখা যায়নি।

ইকবাল রোডে রয়েছে দুটি খেলার মাঠ—একটি উদয়াচল পার্ক ও খেলার মাঠ, আরেকটি ইকবাল রোড পার্ক অ্যান্ড ফিল্ড নামে পরিচিত। দুটি মাঠই এখন আর সরকারি তত্ত্বাবধানে নেই; টিকে আছে শুধু স্থানীয় লোকজনের উদ্যোগে। তবে তদারকি ও ব্যবস্থাপনার দিক থেকে দুটি মাঠের চিত্র এক নয়।

উদয়াচল পার্ক ও খেলার মাঠটি স্থানীয় লোকজনের উদ্যোগে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরলেও নোংরা হয়ে পড়ে আছে ফুটপাত, ওয়াশরুম। সোসাইটির সভাপতি সৈয়দ রুম্মানের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তাঁরা নিজস্ব উদ্যোগে মাঠ রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন। সিটি করপোরেশন মাঠের কোনো তদারকি করছে না। মাদকসেবী ও বখাটেদের হাত থেকে রক্ষা করতে নিরাপত্তাকর্মীর প্রয়োজন। নিয়মিত পরিচ্ছন্নতাকর্মীরও প্রয়োজন। কিন্তু সিটি করপোরেশন থেকে এসব সহযোগিতা তাঁরা পান না।

উদয়াচল মাঠে নিয়মিত হাঁটতে আসেন সাবেক ব্যাংকার আমিনুর রহমান। তিনি বলেন, গত ৫ আগস্টের আগে এই মাঠে বিশৃঙ্খলা ছিল। মাদকাসক্তদের আড্ডা ছিল। মানুষকে হাঁটতে বিড়ম্বনায় পড়তে হতো। কিন্তু ৫ আগস্টের পর এখানকার চিত্র কিছুটা পাল্টেছে। এখন মাদকাসক্তদের আড্ডা নেই। তবে মাঠের তদারকি ঠিক নেই। এই এলাকায় বসবাসকারীদের সমন্বয়ে মাঠের তদারকি হয়। মাঠের বিভিন্ন উন্নয়নকাজ করার দরকার হলেও সিটি করপোরেশন থেকে কোনো উদ্যোগ নেই।

অন্যদিকে ইকবাল রোড পার্ক অ্যান্ড ফিল্ড কিছুটা ব্যতিক্রম। এটি স্থানীয় একটি ক্লাব কমিটির তত্ত্বাবধানে চলছে। নিজস্ব অর্থায়নে পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তা ও নিয়মিত ব্যবস্থাপনা রক্ষা করে মাঠটিকে সচল রাখা হয়েছে। বলতে গেলে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় টিকে থাকার লড়াইয়ে আছে এই মাঠটি।

মাঠ ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এস এম মতিন বলেন, ‘আমরা যদি নিজেরা এগিয়ে না আসতাম, তাহলে এই মাঠ মাদকসেবীদের আখড়ায় পরিণত হতো। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই আমরা মাঠ রক্ষা করছি। তবে সব ব্যয় আমাদেরই বহন করতে হয়।’

খারাপ অবস্থা লালমাটিয়া ডি ব্লকের মাঠটির। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে তদারকির অভাবে চুরি হয়ে গেছে মাঠের বিভিন্ন স্থাপনার লোহালক্কড়। নিরাপত্তার জন্য থাকা সিসিটিভি ক্যামেরাগুলোও নেই। চুরি হয়েছে শিশুদের বিভিন্ন খেলনা। বেড়েছে মাদকসেবী ও ছিনতাইকারীদের আনাগোনা।

কথা হয় লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি নিরাপত্তা কমিটির সহসভাপতি ইয়াহইয়া রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, বর্তমান সিটি করপোরেশন এই মাঠের কোনো তদারকি করছে না। ২০২২ সালে মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে এই মাঠে সিসিটিভি, খেলাধুলার সামগ্রী, ইলেকট্রিক পোল বসানো হয়। এসবের অনেক কিছুই চুরি হয়ে গেছে। মাঠের সম্পদ রক্ষায় সোসাইটির উদ্যোগে তাঁরা এখন যথাসাধ্য দেখভাল করছেন।

লালমাটিয়া এ ব্লকের খেলার মাঠটির সংস্কারকাজ (আড়ংয়ের পেছনে) দীর্ঘদিন ধরে চলছে। মাঠে ফেলে রাখা হয়েছে বালু। খেলাধুলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এলাকার শিশু–কিশোরেরা।

মোহাম্মদপুর ও লালমাটিয়া এলাকার মাঠগুলোয় নিরাপত্তা ও মাদকসংশ্লিষ্টতার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইফতেখার হাসান বলেন, ‘আমরা নিয়মিতভাবে মাঠগুলোয় অভিযান পরিচালনা করি। এরপরও অপরাধ কিছু ঘটে। কিন্তু আগে অপরাধের মাত্রা মহামারি আকারে ছিল, সেটা এখন কমে আসছে। মোহাম্মদপুরের এই সমস্যা অনেক পুরোনো।’ তাঁরা সীমিত জনবল দিয়ে মাদক ও অন্যান্য অপরাধ আরও নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

শিশুদের বিভিন্ন খেলনা ও মাঠগুলোর বিভিন্ন সরঞ্জাম চুরি হওয়ার বিষয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সম্পত্তি কর্মকর্তা ফারজানা খানম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাঠগুলোর তত্ত্বাবধানে আমরা নিরাপত্তা দিয়ে থাকি অথবা নিরাপত্তা বিভাগকে অবগত করে থাকি। কিন্তু যেহেতু মাঠের রক্ষণাবেক্ষণ না থাকার কথা বলা হচ্ছে, আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে মাঠ রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’