ছিলেন ব্রিটিশ দারোগা, পরে জমিদার, তাঁর গড়া ১৮৪ বছরের পুরোনো মসজিদ

পুরান ঢাকার বাবুবাজারে বুড়িগঙ্গার তীরে ১৮৪ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে মসজিদটি। স্থানীয় বাসিন্দারা একে ‘ঘাট মসজিদ’ হিসেবেই চেনেন। তবে ইতিহাসের বই ও নথিতে এটি পরিচিত তার প্রতিষ্ঠাতার নামে— ‘দারোগা আমির উদ্দিন মসজিদ’ হিসেবে।

‘দারোগা আমির উদ্দিন মসজিদ’ । স্থানীয়দের কাছে এটি ‘ঘাট মসজিদ’ হিসেবে পরিচিত। ঢাকা, ২৩ মার্চছবি: প্রথম আলো

বসন্তের রৌদ্রতপ্ত দুপুর। বাণিজ্যে ব্যস্ত পুরান ঢাকার বাবুবাজারের সড়কগুলো অগণিত রিকশা, ঠেলাগাড়ি, রিকশাভ্যান আর যান্ত্রিক যানবাহনে ঠাসা। এগিয়ে যাচ্ছে পিঁপড়ার মতো মন্থরগতিতে। খররোদ পুড়িয়ে দিচ্ছে পাইকারি ব্যবসায় গায়ে–গতরে খাটা শ্রমিক, রিকশাচালক, যাত্রী আর পথচলতি লোকদের। চারপাশে নানা মাপ ও আকৃতির অসংখ্য দরদালান। কিন্তু ছায়া দেওয়ার মতো কোনো গাছপালার চিহ্ন নেই।

সেই যান-জনতার স্রোতে ভেসে যাওয়ার মতো করে বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতুর পাশ দিয়ে নদীর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে যেন মরুভূমিতে মরূদ্যানের মতো দেখা হলো একমুঠো সবুজের সঙ্গে। খিলান-গম্বুজে শোভিত শ্বেতশুভ্র এক সমাধি ঘিরে গড়ে উঠেছে কিছু গাছগাছালি স্নিগ্ধ সবুজ সমারোহ। সমাধি ছাড়িয়ে আরেকটু সামনে সবুজ রঙের তিন গম্বুজ মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক প্রাচীন মসজিদ। সিঁড়ি বেয়ে তার ছাদে উঠতেই বুড়িগঙ্গার বুক ছুঁয়ে আসা ঝিরঝির দখিনা হাওয়ার স্পর্শে ঘুচে গেল পথের ক্লান্তি।

বাবুবাজারে বুড়িগঙ্গার তীরে এই মসজিদ দাঁড়িয়ে আছে ১৮৪ বছর ধরে। স্থানীয় বাসিন্দারা একে ‘ঘাট মসজিদ’ হিসেবেই চেনেন। তবে ইতিহাসের বই ও নথিতে মসজিদটি পরিচিত তার প্রতিষ্ঠাতার নামে ‘দারোগা আমির উদ্দিন মসজিদ’ হিসেবে। মসজিদের প্রাঙ্গণে মোগল স্থাপত্যরীতির এক গম্বুজবিশিষ্ট সমাধিটি দারোগা আমির উদ্দিনের। সমাধিফলকে লেখা ‘মরহুম মৌলভী দ্বারকা আমির উদ্দিন’। জন্ম ১৮১৮, মৃত্যু ১৮৮৮।

আরও পড়ুন

ঢাকার ইতিহাসবিষয়ক বইগুলোতে দারোগা সাহেব সম্পর্কে যেসব তথ্য পাওয়া গেল, তার সারসংক্ষেপ হলো: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর থানার রূপসদী গ্রামে তাঁর জন্ম। সম্ভবত ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে পুলিশ বিভাগের দারোগা ছিলেন। সেই আমলে, যখন তিনি কোম্পানির দারোগা হয়েছিলেন তখন, একটি সম্পন্ন পরিবার থেকেই তিনি এসেছিলেন তা অনুমেয়। পারিবারিক বিত্ত ছাড়া চাকরি থেকেও তিনি প্রচুর ধনসম্পদ অর্জন করেছিলেন। একপর্যায়ে তিনি ত্রিপুরার বরদাখাত পরগনায় ২২টি মৌজার এক বিশাল জমিদারি কিনে ফেলেন। এতে তাঁর বিত্তবৈভব বৃদ্ধির পাশাপাশি সামাজিক আভিজাত্যও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ঢাকায় বুড়িগঙ্গার তীরে প্রাসাদতুল্য বসতবাড়ি আর মোগল স্থাপত্যরীতিতে তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি তিনি নির্মাণ করেন। ইতিহাসবিদদের ধারণা, মসজিদটি সম্ভবত ১৮৪০ সালে নির্মিত।

জমিদারি কিনে কাগজে–কলমে ‘জমিদার’ হলেও জনগণের মুখে তাঁর ‘দারোগা’ পরিচিতির পরিবর্তন হয়নি। ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর ১৯৫০ সালে প্রজাস্বত্ব আইনের মধ্য দিয়ে জমিদারি প্রথা লুপ্ত হয়েছিল। আমির উদ্দিনের সেই প্রাসাদোপম বাড়িটিও আর খুঁজে পাওয়া যায় না। টিকে আছে তাঁর ‘দারোগা’ পরিচিতি আর মোগল স্থাপত্যরীতির ঐতিহ্য বহন করা তিন গম্বুজ মসজিদ। এখন এটি দেশের এক অমূল্য প্রত্নসম্পদ।

দারোগা আমির উদ্দিন মসজিদটির অবস্থান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে
ছবি: প্রথম আলো

মসজিদের উত্তর পাশের দারোগা আমির উদ্দিনের সমাধিকে কেন্দ্র করে বেশ খানিকটা জায়গায় কবরস্থান করা হয়েছে। বাবুবাজার মহল্লার স্থায়ী বাসিন্দাদের অনেককে ইন্তেকালের পরে এখানে দাফন করা হয়। এই জায়গাটুকু ঘিরেই উদ্যানের মতো করে সবুজের সমাবেশ গড়ে তোলা হয়েছে। পশ্চিম পাশে আম আর কাঁঠালগাছ। মুকুল ঝরে গিয়ে ডালে ডালে আমের গুটি বেড়ে উঠছে রোদ-বৃষ্টিতে। নতুন মুছি এসেছে কাঁঠালগাছে। দক্ষিণ পাশে নিমগাছের শাখায় ঝলমল করছে কচি সবুজ পাতা। দুটি আমড়াগাছও আছে উত্তর–দক্ষিণ দুই পাশে। অজস্র ফুল এসেছে নিষ্পত্র শাখায় শাখায়। পুবে একটি মাঝারি আকারে আতাগাছ। সেটিও ভরে আছে ফলে ফলে। সমাধি আর কবরস্থান লোহার নিচু গ্রিল দিয়ে ঘেরা। তার পাশ দিয়ে শোভাবর্ধনকারী মৌসুমি ফুলপাতার গাছের সারি। সবটা মিলিয়ে বেশ ছায়াময় সৌম্য শান্ত পরিবেশ।

সমাধির দক্ষিণ পাশেই মসজিদ। মূল মসজিদের দৈর্ঘ্য ১৫ দশমিক ২৪ মিটার এবং প্রস্থ ৮ দশমিক ২৩ মিটার। গম্বুজ তিনটির মধ্যমটি আকারে বড় পাশের দুটি অপেক্ষাকৃত ছোট, এই দুটি একই সমান। চুন-সুড়কিতে তৈরি গম্বুজগুলো হয়তো আদিতে ইটের গুঁড়ার রঙেই ছিল। মাঝখানে সাদা রং করা হয়েছিল। অধুনা সংস্কারের পরে এখন তার সবুজ বর্ণ। চার কোণে রয়েছে চারটি বুরুজ। মাঝে সরু দুটি করে মিনার। গম্বুজ, বুরুজ ও মিনারে শীর্ষে রয়েছে পিতলের তৈরি লম্বা কলসি ও পুষ্প আকৃতির চূড়া। চকচক করছে রোদে।

মসজিদের পুবের দেয়ালে তিনটি প্রবেশপথ। মাঝেরটি বড়। এগুলো অর্ধবৃত্তাকার। উত্তর ও দক্ষিণেও একটি করে ছোট দরজা। পশ্চিমে দেয়ালেও পুবের দেয়ালের দরজা বরাবর দুটি ছোট ও মাঝে প্রধান মিহরাব। এগুলোও অর্ধবৃত্তাকার। প্রধান মিহরাবটি সংস্কার করে সবুজ ও খয়েরি রঙের মার্বেল পাথর দিয়ে মুড়িয়ে রাখা। মেঝেতে মার্বেলকুচির মোজাইক।

দারোগা আমির উদ্দিনের সমাধি। তিনি ১৮১৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুবরণ করেন ১৮৮৮ সালে
ছবি: প্রথম আলো

মূল মসজিদের ভেতরে মুসল্লিদের জন্য তিন সারি ও বারান্দায় চার সারি রয়েছে। এরপর বারান্দার সামনে এবং দুই পাশে আরও খানিকটা সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এখন মূল সমজিদের সামনে বারান্দার ছাদ সম্প্রসারণ করে সেখানেও সাত সারিতে নামাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে দেড় হাজারের মতো মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন।

দারোগা আমির উদ্দিন মসজিদ পরিচালিত হয় ওয়াকফ ট্রাস্টের মধ্যমে। বর্তমান মোতোয়ালি মো. সরাফত আলী ও পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. আমিনুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলো মসজিদটি নিয়ে। তাঁরা জানালেন, মসজিদটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে। হোল্ডিং নম্বর ১, ২ আকমল খান রোড, বাবুবাজার। এখন মোট জায়গা আছে ৩৪ দশমিক ৯০ শতাংশ।

আরও পড়ুন

মসজিদের দক্ষিণ ও পশ্চিম পাশের অনেকটা জায়গা হুকুমদখল করা হয়েছে বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতু নির্মাণকালে। এ ছাড়া পূর্ব দিকেও বেশ খানিকটা জায়গা নিয়েছে বিআইডব্লিউটিসি। বহুদিন ওয়াকফ বোর্ড ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেনদরবার করে পূর্ব দিকে খানিকটা অংশে উদ্ধার করে প্রবেশপথ তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু শেষ প্রান্তে এখনো তাদের দুটি ঘর রয়েছে।

মসজিদের উত্তর-পশ্চিম পাশে টিনের ছাউনি দিয়ে নুরানি হেফজখানা ও মক্তব করা হয়েছ ২০১৮ সালে। মসজিদের ইমাম মাওলানা মো. আম্মার হোসেন জানালেন, এখন প্রায় দেড় শ ছাত্র এখানে রয়েছে। প্রতিদিন ছাত্রসহ প্রায় আড়াই শ সাধারণ মানুষের ইফতারির ব্যবস্থা করা হয় মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে। মোতোয়ালি ও সম্পাদক জানালেন, আগে এই মক্তবের জায়গায় দোকানপাট, হোটেল, টং গড়ে উঠেছিল।

দারোগা আমির উদ্দিন মসজিদের ভেতরের দৃশ্য
ছবি: প্রথম আলো

আম্মার হোসেন বলেন, একটি প্রভাবশালী মহল চেষ্টা করছিল এখানে সব স্থাপনা ভেঙে নতুন করে মসজিদ ও বহুতল বাণিজ্যিক ভবন গড়ে তোলার। তবে তাঁরা এলাকাবাসীকে নিয়ে এই অপচেষ্টা ঠেকানোর চেষ্টা করছেন। এরই একপর্যায়ে দোকানপাট তুলে দিয়ে মক্তব করা হয়েছে। তাঁরা জানালেন, বর্তমান কমিটি পুরান ঢাকা তথা দেশের ঐতিহ্যবাহী এই অমূল্য প্রাচীন স্থাপনাটি টিকিয়ে রেখে বাকি জায়গায় একটি মাদ্রাসা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছেন। তবে নানামুখী চাপ ও প্রতিবন্ধকতার কারণে কাজ এগিয়ে নিতে পারছেন না।

বাণিজ্যময় এই সময়ে লোভ-লাভই যখন প্রবল পরাক্রমে পরম মোক্ষের স্থান দখল করতে বসেছে, তখন ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি তার শক্তি নিয়ে কতখানি নিজের গুরুত্ব ও অধিকার বজায় রাখতে পারবে কে জানে?

আরও পড়ুন