ধসে পড়ার ঝুঁকিতে ৯ লাখ ভবন

রাজউকের সমীক্ষাটিতে বলা হয়, মধুপুর চ্যুতিরেখায় ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকায় মারা যেতে পারেন ২ লাখ ১০ হাজার মানুষ।

  • ভূমিকম্পে আর্থিক ক্ষতি হবে ২ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। 

  • ১৮৯৭ সালে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ ও রংপুর শহরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।

ফাইল ছবি প্রথম আলো

ঢাকা ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। টাঙ্গাইলের মধুপুরে মাটির নিচে যে চ্যুতিরেখা বা ফল্টলাইন রয়েছে, সেখানে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় ৮ লাখ ৬৫ হাজার ভবন ধসে পড়বে। দিনের বেলায় এ ভূমিকম্প হলে মারা যাবেন ২ লাখ ১০ হাজার মানুষ, আহত হবেন ২ লাখ ২৯ হাজার।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) এক সমীক্ষায় এই ঝুঁকির বিষয়টি উঠে এসেছে। সংস্থাটি বলছে, মধুপুর চ্যুতিরেখায় ওই মাত্রার ভূমিকম্পে আর্থিক ক্ষতি হবে ২৫ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকার সমান। ভূমিকম্পের পর ভবন মেরামত ও পুনর্নির্মাণে সরকারকে ব্যয় করতে হবে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলার (৪ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা)।

রাজউক এ সমীক্ষা করেছে আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের রাজউক অংশের আওতায়। এ প্রকল্পের ব্যয় ৫৩৬ কোটি টাকা ব্যয়। এতে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

সচিবালয়ে আজ বুধবার গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সভায় সমীক্ষা প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হবে। সভায় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সচিব ও দুর্যোগবিশেষজ্ঞরা উপস্থিত থাকবেন। জানতে চাইলে প্রকল্পটির পরিচালক আবদুল লতিফ হেলালী প্রথম আলোকে বলেন, ভূমিকম্পের ভয়াবহতা নিয়ে বড় আকারে এ ধরনের সমীক্ষা এবারই প্রথম করা হয়েছে। ২০১৮ থেকে ২০২২—এই চার বছর ধরে সমীক্ষাটি করা হয়।

রাজউকের কর্মকর্তারা বলছেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থান দুটি বিপজ্জনক চ্যুতিরেখার ওপরে। একটি ঢাকা মহানগরের সবচেয়ে কাছে টাঙ্গাইলের মধুপুর চ্যুতিরেখা, অন্যটি সিলেট অঞ্চলের ডাউকি চ্যুতিরেখা। ঢাকা মহানগরের ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা আওতায় নিয়ে সমীক্ষাটি করা হয়।

সমীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সিলেটের ডাউকি চ্যুতিরেখায় ৭ দশমিক ১ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে ঢাকার কমপক্ষে ৪০ হাজার ৯৩৫টি ভবন ধসে পড়বে। দিনের বেলায় ভূমিকম্পটি হলে ১৬ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। আহত হবেন ২৮ হাজার মানুষ। এই মাত্রার ভূমিকম্পে আর্থিক ক্ষতি হবে ৫ বিলিয়ন ডলার, যা সাড়ে ৫২ হাজার কোটি টাকার সমান। ভূমিকম্পের পর ভবন মেরামত ও পুনর্নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার (সাড়ে ৭৩ হাজার কোটি টাকা)।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দিনে ভূমিকম্প হলে মানুষের মৃত্যু বেশি হবে। কারণ, এই সময় বাণিজ্যিক ভবন ও কারখানায় মানুষ বেশি থাকেন। আর ঢাকায় ভবনগুলোর ধসে পড়ার ঝুঁকির কারণ, অনেক ভবন জলাভূমি ভরাট করে নরম মাটিতে তৈরি করা হয়েছে। আবার নির্মাণের ক্ষেত্রেও ভূমিকম্পসহনীয় করা হয়নি। অনেক ভবনই অবৈধভাবে নির্মিত।

তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তে গত ৬ ফেব্রুয়ারি ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। স্থানীয় সময় ভোর সোয়া চারটায় ওই ভূমিকম্পে প্রাণহানি ৫৫ হাজার ছাড়িয়েছে। জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনডিপির তথ্যমতে, ওই ভূমিকম্পে ২ লাখ ২০ হাজার ভবন ধসে পড়ে। আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয় ১০০ বিলিয়ন (১০ লাখ কোটি টাকার বেশি) ডলারের বেশি।

বাংলাদেশে ভূমিকম্প

মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠেয় সভার কার্যপত্রে বাংলাদেশে অতীতে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের ঘটনাগুলোর তথ্য উল্লেখ করা হয়। জানানো হয়, ১৮৯৭ সালে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ ও রংপুর শহরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ওই ভূমিকম্পে দেড় হাজার মানুষ মারা যান।

২০২১ সালে সিলেটে পরপর সাতবার ও চট্টগ্রামে তিনবার মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়। গত বছর এবং এ বছরের শুরুতে সিলেট, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে বেশ কয়েকবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এসব ছোট–বড় ভূমিকম্প ভবিষ্যতে বাংলাদেশে বেশি মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকির কথা জানান দেয় বলে উল্লেখ করা হয় কার্যপত্রে।

ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব

এদিকে ভূমিকম্প নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কাজ করতে একটি স্বতন্ত্র ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করতে চায় রাজউক, যার নাম হবে বাংলাদেশ স্ট্রাকচারাল রিস্ক অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স ইনস্টিটিউট (বিএসআরআরআই)। প্রস্তাবনায় এই ইনস্টিটিউটের লক্ষ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ভূমিকম্প ও দুর্যোগ সহনশীল নগর নির্মাণে গবেষণা করা এবং দুর্যোগ–পরবর্তী কার্যক্রমে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি সেবা দেওয়া। ইনস্টিটিউটটির কার্যালয় হবে ঢাকার মহাখালীতে। ১০ তলা ভবনে শুধু ভূমিকম্প সম্পর্কে গবেষণা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

নথিপত্র বলছে, প্রস্তাবিত ইনস্টিটিউটের সম্ভাব্য পরিচালনা পর্ষদ হবে ১২ সদস্যের। যেখানে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চেয়ারপারসন রাখা হয়েছে।

সচিবালয়ে অনুষ্ঠেয় আজকের পর্যালোচনা সভায় এ প্রস্তাবের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। তবে নতুন ইনস্টিটিউট করে কতটুকু লাভ হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাজউক থাকার পরও ঢাকায় অপরিকল্পিতভাবে, নিয়ম না মেনে, অবৈধভাবে হাজার হাজার ভবন হয়েছে। তাই একটি সংস্থা থাকলেই কাজ হয় না। নতুন সংস্থা মানে হলো সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি ও আমলাদের পদায়নের সুযোগ। নতুন প্রকল্প মানে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের দুর্নীতির সুযোগও তৈরি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী সমীক্ষাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকির ভয়াবহতা বোঝার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে সমীক্ষাটি করা হয়েছে।

সমীক্ষা করা হয়েছে রাজনীতিবিদদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য, যাতে তাঁরা ভূমিকম্পের ভয়াবহতা ও গুরুত্বটা বুঝতে পারেন এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা নেন। ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় একটি নতুন ইনস্টিটিউট করার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, সেখানে যাতে আমলাদের প্রভাব না থাকে। এটিকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে।