শিল্পের আলোয় ইতিহাসের পাঠ

ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে শুরু হয়েছে শিল্পী ঢালী আল মামুনের একক শিল্পকলা প্রদর্শনী ‘অসম্মতির মানচিত্র’
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

ইতিহাসের বাঁকবদল ঘটে। উত্থান-পতনে, বিদ্রোহে-বিপ্লবে সংযোজিত হয় নতুন অধ্যায়। এর সঙ্গে মানচিত্রও বদলে যায়। ইতিহাসের এই পালাবদলের তাৎপর্য উপলব্ধি করে তা শিল্পের রসে জারিত করে উপস্থাপন করেছেন শিল্পী ঢালী আল মামুন। ঔপনিবেশিক কালের শিক্ষাসহ নানা উপাদান আমাদের চিন্তা ও সৃজনশীল জগতে যে প্রভাব ফেলছে, তাই উঠে এসেছে তাঁর বহু মাধ্যমের বৈচিত্র্যময় কাজের যোজনায় ‘অসম্মতির মানচিত্র’ নামের প্রদর্শনীতে।

শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে শুরু হয়েছে শিল্পী ঢালী আল মামুনের এই একক শিল্পকলা প্রদর্শনী। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও লেখক অধ্যাপক রওনক জাহান প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন। প্রদর্শনী চলবে আগামী ২৬ মার্চ পর্যন্ত। মঙ্গলবার ছাড়া প্রতিদিন বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত উন্মুক্ত থাকবে।

রওনক জাহান বলেন, ‘নানাভাবে আমাদের ওপরে বিভিন্ন রকমের ইতিহাস চাপিয়ে দেওয়া হয়। শিল্পীদের একটি প্রধান কাজ, ইতিহাসের অসংগতিকে প্রশ্ন করা। ঢালী তাঁর শিল্পকর্মের ভেতরে সেই প্রশ্ন তুলেছেন। ঔপনিবেশিক আমলে আমাদের যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, বিভিন্ন উপকরণ ও প্রতীকের ভেতর দিয়ে তা শিল্পী উপস্থাপন করেছেন। এটা দর্শকদের ভাবনাকে প্রসারিত করবে। এখানে তিনি নিয়ন্ত্রণের প্রতীক হিসেবে তালপাতার সেপাইয়ের আদলে শিল্পকর্ম করেছেন। এ ছাড়া বাণিজ্যিক উপাদান হিসেবে চা, মসলা, নীল, এসব ব্যবহৃত হয়েছে।’

উদ্বোধনী দিনে শিল্পী, শিল্প সমালোচক, লেখক, সাহিত্যিক আর শিল্পানুরাগী দর্শকদের সমাগমে ভরা ছিল প্রদর্শনী কক্ষ
ছবি: প্রথম আলো

আলোচক ছিলেন প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক কবি সাজ্জাদ শরিফ। তিনি বলেন, সাম্রাজ্য অস্ত গেছে, কিন্তু মানচিত্র রয়ে গেছে। তবে ঢালী তাঁর কাজ মানচিত্রে সীমাবদ্ধ রাখেননি। দেশগুলোর ভেতরে ক্ষমতার বণ্টন হয়েছে। তবে মানসিকভাবে ঔপনিবেশিকতার প্রভাব রয়েছে। শিল্পী চিত্রকর্মের পাশাপাশি, ভাস্কর্য, স্থাপনা, চলমান স্থাপনা, বুনন, ভিডিও ও নানা রকম উপাদান ব্যবহার করে তাঁর উপলব্ধির জগৎকে প্রকাশ করছেন। তিনি একটি নতুন চিত্রভাষা সৃজন করেছেন।

ঢালী আল মামুন তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, দীর্ঘদিন থেকে তিনি ঔপনিবেশিক ইতিহাস নিয়ে কাজ করছেন। ইতিহাসের ক্রমাগত অনুসন্ধান তাঁর ভেতরে নানা প্রশ্ন তৈরি করেছে। অবচেতনে ঔপনিবেশিক শিক্ষার প্রভাব আমাদের মনন ও চিন্তার জগৎকে বহুলাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। এসব ভাবনা থেকে নিজস্ব একটি ভাষা নির্মাণের জন্যই তাঁর চেষ্টা।

আলোচনা অনুষ্ঠানের শুরুতে বক্তব্য দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও লেখক রওনক জাহান প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন
ছবি: প্রথম আলো

প্রদর্শনীটি ভিন্ন রকম বলেই মনে হবে দর্শকদের। প্রদর্শন কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করলেই মেঝেজুড়ে বড় স্থাপনাকর্মটি দৃষ্টি কাড়বে সবার আগে। রেলের ব্যবহৃত কাঠের স্লিপারগুলো প্রায় হাঁটুসমান উঁচু কাঠামোর ওপর বিছিয়ে রাখা হয়েছে। সেটি গিয়ে মিশেছে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা বাংলাদেশের মানচিত্রের সামনে। সেই দেয়ালটি আবার ঢেকে দেওয়া চা–পাতা দিয়ে। আর স্লিপারের ওপর সাদা, লাল ও কালো রঙের তিনটি উপনিবেশ স্থাপনকারীদের মানুষের মাথাযুক্ত সারমেয় দাঁড়িয়ে আছে বিশেষ ভঙ্গিতে। ব্রিটিশরাই ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের শাসন ও বাণিজ্যের প্রসারের জন্য রেলপথের সম্প্রসারণ করেছিল।

পাটের সুতোর বুননে তৈরি একটি পোশাক এক পাশে ঝুলিয়ে রাখা। এ রকম পোশাক পরিধান করতেন ব্রিটিশ লর্ডরা। আছে মুকুট ও মানুষের করোটি। বৃত্তাকার ফলকে আঁকা ছবিতে এসেছে পলাশী ও বক্সারের যুদ্ধের দৃশ্য। এ কাজগুলো করা হয়েছে নকশিকাঁথার আঙ্গিক ব্যবহার করে। ফলে দর্শকদের ছবিগুলো দেখতে হয় বৃত্তাকার ফলকটির চারপাশে ঘুরে ঘুরে। দেয়ালেও ছবি আছে। আছে চা–পাতার আস্তরণ দেওয়া রেল ইঞ্জিনের ভাস্কর্য।

সেপাইগুলো বেশ চমকপ্রদ। তালপাতার সেপাইয়ের আদলে কাঠ দিয়ে এই পুতুলগুলো তৈরি করা হয়েছে বেশ বড় আকারে। তার কিনার দিয়ে জুড়ে দেওয়া ঘুঙুরের সারি। এই পুতুলগুলোর লম্বা দণ্ডগুলো একটি বাক্সের ওপর বসানো। যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সেগুলো ডানে–বাঁয়ে ঘোরানো হচ্ছে। ফলে এই পুতুলগুলো যখন তাদের হাত-পা নাড়ছে, তখন ঘুঙুরগুলোও বেজে উঠছে। শব্দে–দৃশ্যে সৃষ্টি হচ্ছে এক অন্য রকম আবহ।

এ ছাড়া প্রদর্শন কক্ষের মেঝেতে গম্বুজের আদলে তৈরি একটি ধাতব আকৃতির ভেতরে মনিটরে একটি ভিডিও স্থাপন করা হয়েছে। আরেকটি ভিডিও চলছে কক্ষের অন্য পাশে, কালো কাপড়ের দেয়াল দিয়ে ঘেরা একটি আলাদা প্রেক্ষাগৃহের আদলে তৈরি করা জায়গায়। এসব ভিডিও চিত্রে প্রদর্শনীর কাজগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।

উদ্বোধনী দিনে শিল্পী, শিল্প সমালোচক, লেখক, সাহিত্যিক আর শিল্পানুরাগী দর্শকদের সমাগমে ভরা ছিল প্রদর্শনী কক্ষ। শিল্পের আলোয় ইতিহাসের পাঠ নিতে আগ্রহীরা আসতে পারেন এই বহুমাত্রিক শিল্পকলার দৃষ্টিনন্দন প্রদর্শনীতে।