ওএমএসের পণ্য পেতে সেমালা–আমজাদদের ভোর থেকে অপেক্ষা

ওএমএসের ট্রাক আসবে না জেনে ফেরত যাচ্ছেন সেমালা বেগম। কাঁঠালবাগান, ঢাকা, ১৬ নভেম্বর
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

মধ্য বয়সী আমজাদ হোসেন একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী। রাজধানীর বাংলামোটর এলাকায় থাকেন তিনি। ১০ থেকে ১২ হাজারের মতো আয়ে সংসার চলে টানাটানিতে। এ জন্য আজ বুধবার সকাল সাতটার আগে খাদ্য অধিদপ্তরের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ওপেন মার্কেট সেলের (ওএমএস) চাল ও আটা কিনতে রাজধানীর পরিবাগ এলাকার মোতালেব প্লাজার পেছনে আসেন। এখানে কমদামে চাল ও আটা পাওয়া যায় শুনে এসেছেন তিনি। তবে ভোরে এসে লাইনে দাঁড়ানোর পরও তাঁর সিরিয়াল পড়েছে ২৮ নম্বরে। অর্থাৎ, আমজাদ হোসেনের আগে আরও ২৭ জন এসে সারিবদ্ধ হয়েছেন। ইটের টুকরা, কাট বা পণ্য নেওয়ার প্যাকেট রেখে জায়গা ধরেছেন কেউ কেউ।

আমজাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে নিয়মিত চাল ও আটা দিত। এ জন্য সকালে এসে সিরিয়াল দিলাম। তবে আমার আগে আরও অনেকে এসেছেন। কিন্তু এখানে এসে শুনলাম, কয়েক দিন ধরে নাকি এখানে ট্রাক আসছে না। আজ আসবে কি না, তা নিশ্চিত না। কাজ ফেলে এসে অপেক্ষা করছি। দেখি, কী হয়।’

রাজধানীর নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সরকারের ওএমএসের চাল ও আটা পেতে পরিবাগের এ জায়গায় আজ ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত শতাধিক লোক সারিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলেও ট্রাক আসেনি। এতে মানুষের অপেক্ষা বেড়েছে। এখানে আসা অধিকাংশ মানুষ সকালে না খেয়ে এসেছিলেন। অনেকে বলেছেন, এখানকার চাল না পেলে দুপুরে রান্না হবে না। বেলা বাড়তে শুরু করলে কেউ কেউ আবার কাজের প্রয়োজনে সারি ভেঙে চলেও যেতে শুরু করেন।

তেমনই একজন ভ্রাম্যমাণ চা–বিক্রিতা আবদুল মালেক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসেছি ৬টার পরে। এসে ৬ নম্বর সিরিয়াল পেয়েছি। তবে ১০টা নাগাদ অপেক্ষা করেও চাল পেলাম না। এখন রোজগারের জন্য বের হতে হবে, নাইলে আজকের বাজার করতে পারব না। এখান থেকে চাল নিতে পারলে কিছু সাশ্রয় হতো। কিন্তু আজকে মনে হয় না পণ্য দেবে। কারণ, এর আগে যখন পণ্য নিয়েছি, তখন ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে পণ্য পাওয়া যায়।’

এখানে পণ্য নিতে আসা হাবিবুর রহমানের অবস্থাও প্রায় একই। ইস্কাটন গার্ডেন এলাকায় একটা বাড়িতে নিরাপত্তাকর্মীর কাজ করেন তিনি। কাজ ফেলে আসার ফুরসত নেই। সকালে একজনকে বসিয়ে এসেছেন কম দামে চাল ও আটা কিনতে। কিন্তু সেই ভোর থেকে অপেক্ষা করতে করতে তিনিও ক্লান্ত। এদিকে সকালের খাবারও খাননি।

ওএমএসের ট্রাকের অপেক্ষায় মানুষ। কাঁঠালবাগান, ঢাকা, ১৬ নভেম্বর
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

অনেকটা আক্ষেপ করে হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘টানা দুদিন এসেও পণ্য পেলাম না। কাজ ফেলে বারবার আসা যায়ও না। কিন্তু যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, তাতে ৯ হাজার টাকার বেতনে আমার ৩ সদস্যের সংসার কোনোভাবেই চলে না। বাজার থেকে কিনে খেতে হলে এক বেলা খাই তো অন্য বেলা উপোস থাকতে হয়। কম দামে পণ্য নিতে পারলে তখন অন্তত দুই বেলা খাবার জোটে।’

শুধু পরিবাগ এলাকা নয়। পাশের কাঁঠালবাগান ঢালের চিত্রও একই। এ এলাকায়ও ভোর থেকে অন্তত অর্ধশতাধিক মানুষ অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু এখানে কয়েক দিন ধরে পণ্য না পাওয়ায় সারিতে না দাঁড়িয়ে সবাই এলোমেলো বসে ছিলেন। এর মধ্যে সকাল ৮টার দিকে একটা ট্রাক আসছে শুনে সবাই সারিবদ্ধ হতে শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর জানা যায়, এই ট্রাক অন্যত্র পণ্য দেবে। ট্রাকটি এই এলাকা অতিক্রম করে যাওয়ার সময় ট্রাকের চালক চা খেতে দাঁড়িয়েছিলেন। তাতেই সবাই ভেবে বসেন, এখানে চাল দেওয়া হবে।

কাঁঠালবাগান ঢালের এই রাস্তার মুখে চাল কিনতে আসেন সেমালা বেগম। আজ পণ্য পাবেন না, এমনটা নিশ্চিত হতে পেরে তিনি বাড়ির পথ ধরার সময় প্রথম আলোকে বলেন, ‘চার দিন ধরে আসছি, পণ্য পাই না। বাড়িতে চাল নেই। এখন বলছে চাল দেবে না। এখন যে বাসায় কাজ করি, সেখানে যাব। ফেরার পথে আরেকবার এসে দেখে যাব। তখন যদি চাল দেয়, তাইলে তো ভালো। না হয় কাল আবার আসতে হবে।’

উল্লেখ্য, ওএমএসের মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষেরা ৩০ টাকা কেজি দরে ৫ কেজি করে চাল কিনতে পারেন। আর ১৮ টাকা দরে কিনতে পারেন ৫ কেজি করে আটা। বর্তমান উচ্চ মূল্যের বাজারে কম দামের এসব পণ্য পেতে মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও তা পাচ্ছেন না। বেলা ১১টার দিকে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ওএমএসের পণ্যের ট্রাক আসেনি। তখনো অপেক্ষায় ছিলেন অনেকে।