একটি সড়কের দুঃখগাথা

রাজধানীর ‘প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম সড়ক’। এর দুই পাশ নানাভাবে দখল হয়ে গেছে। গড়ে উঠেছে অবৈধ দোকান, গ্যারেজ। সামান্য বৃষ্টি হলেই একাংশে কয়েক ঘণ্টা পানি জমে থাকে। এই সড়ক যদি নিজের কষ্টের কথা বলতে পারত, সেটি কেমন হতো?লিখেছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সামছুর রহমান

টোলারবাগ এলাকায় ফুটপাত ছাপিয়ে সড়কের ওপর বসেছে কাঁচাবাজার। ঢাকা, ২২ আগস্ট
ছবি: লেখক

আমি প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম সড়ক। টেকনিক্যাল মোড় থেকে মিরপুর-১ নম্বর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত আমার বিস্তৃতি। দৈর্ঘ্যে দুই কিলোমিটার। প্রতিদিন আমার ওপর দিয়ে হাজারো যানবাহন, লাখো যাত্রী-পথচারী চলাচল করে। আমার আশপাশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনা, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু আমাকে দেখার কেউ নেই। দখলে-দূষণে আমার অবস্থা এখন জীর্ণ, প্রাণ যায় যায় অবস্থা।

টেকনিক্যাল মোড়, সরকারি বাঙলা কলেজ, টোলারবাগ আবাসিক এলাকা, সরকারি এ-টাইপ কলোনি, ওয়াক-আপ কলোনি, আনসার ক্যাম্প, দক্ষিণ বিশিল ও মিরপুর–১ নম্বর বাসস্ট্যান্ড এলাকা—ফুটপাত ও সড়ক মিলিয়ে চার শতাধিক অবৈধ দোকান গড়ে উঠেছে আমার ওপরে।

টেকনিক্যাল মোড়ের যেখানে আমার শুরু, সেখানে একদিকে পাশাপাশি দুটি ফিলিং স্টেশন। এখানে ফুটপাতের কয়েক শ ফুট পুরোটাই টিন-বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। ভেতরে সিটি করপোরেশনের অস্থায়ী শ্রমিকেরা থাকেন। সড়কের উন্নয়নকাজের সুবিধার জন্য শ্রমিকদের এখানে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কত দিন এভাবে ফুটপাত বন্ধ রাখা হবে, কেউ জানে না।

এই পথ ধরে কিছুটা এগোলেই ঢাকা ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়। এর পাশেই সরকারি বাঙলা কলেজ। এই সরকারি অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনের ফুটপাত অস্থায়ী দোকানপাটের দখলে। বেশির ভাগ দোকানই নানা ধরনের খাবারের। বাঙলা কলেজের সামনে একটি পদচারী–সেতু আছে। তবে খুব কম মানুষ এটা ব্যবহার করে। এর নিচের অংশ এখন উন্মুক্ত শৌচাগার হিসেবে ব্যবহার করে লোকজন।

টোলারবাগ যাওয়ার আগের অংশে ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিস ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয়। এর মধ্যে শিক্ষা অফিসের সামনে রিকশা মেরামতের দোকান। আর গণপূর্তের সামনের ফুটপাত ফল ও চায়ের দোকানের দখলে। টোলারবাগ এলাকায় ডেলটা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের নতুন ভবন। এই অংশে ফুটপাতের পাশাপাশি সড়কও অনেকটা দখলে চলে গেছে। ফুটপাত ফল, ডাব বিক্রির দোকান আর সড়ক অ্যাম্বুলেন্স, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের মোটরসাইকেলের দখলে।

আনসার ক্যাম্প এলাকায় ফুটপাতের ওপরে গড়ে তোলা হয়েছে খাবারের দোকান। চুলায় রান্না হচ্ছে, এখানে বেঞ্চে বসে খান লোকজন। ঢাকা, ২২ আগস্ট
ছবি: লেখক

টোলারবাগ এলাকায় সড়কের ওপরে গড়ে উঠেছে ভাতের হোটেল। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে দেখলাম, হোটেলে সরপুঁটি মাছ ভাজা হচ্ছে। গরম-গরম সরপুঁটি ভাজা, সবজির সঙ্গে ভাত বিক্রি করছেন পেয়ারা বেগম। রিকশাচালকসহ শ্রমজীবী মানুষেরা এই হোটেলের মূল ক্রেতা।

আনসার ক্যাম্প এলাকার ফুটপাত অনেকটা পরিবেশবান্ধবভাবে দখল করা হয়েছে। এক সারিতে প্রায় ৩০টি নার্সারি ও মাটির তৈজসপত্র বিক্রির দোকান গড়ে তোলা হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসনের সামনের সড়কে গড়ে তোলা হয়েছে মোটরসাইকেল মেরামতের দোকান।

সড়কের এই অংশটুকু দারুস সালাম থানার অধীনে। দোকানিদের অভিযোগ, পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে তাঁরা ব্যবসা করছেন। দোকানপ্রতি দৈনিক ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়।

তবে দোকান থাকার বিষয়টি স্বীকার করলেও চাঁদা নেওয়ার বিষয়টি জানা নেই বলে দাবি করেন দারুস সালাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ আমিনুল বাশার। তিনি বললেন, ‘অনেক দোকান সেটা ঠিক। কোনো পুলিশ সদস্য চাঁদা নেন, এই বিষয়টি জানা নেই। খোঁজ নেওয়া হবে। কেউ জড়িত থাকলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও জানানো হবে।’

টেকনিক্যাল মোড়ে ফুটপাতে টিন-বাঁশ দিয়ে অস্থায়ী ঘর তোলা হয়েছে। সড়ক উন্নয়নকাজের শ্রমিকেরা থাকেন এসব ঘরে। ঢাকা, ২২ আগস্ট
ছবি: লেখক

বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের তথ্যমতে, রাজধানীর ফুটপাত থেকে প্রতিদিন চাঁদা ওঠে ছয় কোটি টাকা। রাজধানীর ৬৫টি এলাকায় অন্তত ৩৮ জন লাইনম্যান সরদারের নেতৃত্বে ফুটপাতে চাঁদাবাজি হয়। চাঁদা তোলার জন্য নিযুক্ত আছেন দেড় শতাধিক লাইনম্যান। চাঁদা তোলার জন্য প্রত্যেক লাইনম্যানের সঙ্গে পাঁচ-সাতজন করে সহযোগী থাকেন। সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রভাবশালী রাজনীতিক ও একশ্রেণির পুলিশ সদস্য মিলে লাইনম্যান সরদার ও লাইনম্যান নিয়োগ দেন। কোনো কোনো এলাকায় ওয়ার্ড কাউন্সিলররাও জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

আমার ওপর দিয়েই ঢাকার নৌ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে যেতে হয়। এই কার্যালয় যে গলিতে, তার প্রবেশমুখে সড়কের ওপরে বাঁশের কাঠামো দিয়ে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে ১০ থেকে ১২টি গাড়ি সার্বক্ষণিক সড়কের ওপরই থাকে। এই গাড়ি রাখার জন্যও চাঁদা দিতে হয়।

টোলারবাগ এলাকায় সরকারি ডি-টাইপ আবাসিক এলাকার প্রবেশমুখে সড়কের ওপরই বসে অস্থায়ী বাজার। প্রতিদিন সকাল ছয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এই বাজারে মেলে শাকসবজি, মাছ, মুরগি, ফল। এই অস্থায়ী বাজারে ৫০টির মতো দোকান রয়েছে। এখানকার দোকানদারেরা জানান, তাঁরা দোকানপ্রতি দৈনিক ৩০০ টাকা চাঁদা দেন। এর মধ্যে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের খরচও আছে।

আনসার ক্যাম্প এলাকায় ফুটপাতে গড়ে উঠেছে প্রায় ৩০টি নার্সারি ও মাটির তৈজসপত্র বিক্রির দোকান। ঢাকা, ২২ আগস্ট
ছবি: লেখক

হিসাব করে দেখলাম, আমার ওপরে গড়ে ওঠা ৪০০ অবৈধ দোকান থেকে দিনে গড়ে ২৫০ টাকা করে আদায় হলে দৈনিক চাঁদা ওঠে ১ লাখ টাকা। মাসে ৩০ লাখ আর বছরে চাঁদার পরিমাণ সাড়ে ৩ কোটি টাকার বেশি। এই চাঁদা ভাগাভাগি হয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, কাউন্সিলরের লোকজন ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের মধ্যে।

আমার অবস্থান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মুরাদ হোসেন। দখল ও চাঁদাবাজির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি নিরুপায়। উচ্ছেদ করলে আবার এসে বসে যায়। প্রশাসন তো নির্বিকার থাকে। প্রশাসনের সহযোগিতা পাওয়া যায় না। আমার নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করলে ঠেকানোর তো উপায় নাই।’

সারা বছর আমার ওপরে চলে এমন অত্যাচার। আমিও অবশ্য সুযোগ পেলে ছাড়ি না। সামান্য বৃষ্টি হলেই কয়েক ঘণ্টা পানি জমিয়ে রাখি, বিশেষ করে মিরপুর–১ নম্বর বাসস্ট্যান্ড এলাকায়। তখন বছরজুড়ে আমার ওপরে চলা অত্যাচারের প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ পাই!