অসহনীয় গরমের বড় কারণ অপরিকল্পিত উন্নয়ন

‘শহরাঞ্চলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি: কারণ ও করণীয় শীর্ষক’ গোলটেবিল বৈঠকে আলোচক ও অতিথিরা। বুধবার প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি) মিলনায়তনেছবি: প্রথম আলো

দেশে এবার যে তাপ বা গরম অনুভূত হয়েছে, তা ১৩০ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। আগামী বছরও এমন অসহনীয় গরম থাকতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি এমন গরমের বড় কারণ অপরিকল্পিত উন্নয়ন। দেশকে এ তাপ থেকে রক্ষা করতে বর্তমান উন্নয়ন মডেলের বিকল্প প্রয়োজন।

‘শহরাঞ্চলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি: কারণ ও করণীয় শীর্ষক’ গোলটেবিল বৈঠকে উঠে এল এসব কথা। আজ বুধবার রাজধানীর পিআইবি মিলনায়তনে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজক ছিল বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এবং বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইনডিজেনাস নলেজ (বারসিক)।

গোলটেবিল বৈঠকের সভাপতি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম শহীদুল ইসলাম। ঢাকায় অসহনীয় গরম অনুভূত হওয়ার একটি কারণ জলবায়ু পরিবর্তন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে অপরিকল্পিত উন্নয়ন।

শহীদুল ইসলাম বলেন, গাছ কাটা হচ্ছে। বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে জলাধারগুলো। উড়ালসড়কসহ নানা রকম উন্নয়ন কাজ হচ্ছে। এসব মানুষের উন্নয়ন, এর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কোনো সম্পর্ক নেই। এই অপরিকল্পিত উন্নয়নের মাধ্যমে শহরকে একটা চুলার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) চিফ হিট অফিসার বুশরা আফরিন বলেন, মানব ইতিহাসে সবচেয়ে উত্তপ্ত গ্রীষ্মকালের একটি ছিল এবার। আগামী গ্রীষ্মকালে আরও বেশি গরম অনুভূত হতে পারে। কারণ, প্রকৃতিতে ‘এল নিনো’ থাকবে।

পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলীয় প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা যখন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে, তখন তাকে এল নিনো বলা হয়। এর প্রভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি আবহাওয়ায় বৈরী পরিস্থিতি দেখা দেয়।

আগামী গ্রীষ্মের উত্তাপ মোকাবিলায় সবাই প্রস্তুত কি না, সেই প্রশ্ন করেন বুশরা আফরিন। এর জন্য প্রস্তুত হওয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি। রাস্তা চওড়া করার সময় যখন সব গাছ কাটা হয়, তা দেখে খারাপ লাগে জানিয়ে বুশরা আফরিন বলেন, অবশ্যই অবকাঠামো উন্নয়ন দরকার। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের জায়গাগুলো চিহ্নিত করে তা প্রাধান্যের জায়গায় রাখতে হবে।

গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য খোদেজা নাসরিন। তিনি বলেন, এমন অসহনীয় তাপমাত্রা থেকে রেহাই পেতে সরকারের পাশাপাশি নাগরিকদেরও দায়িত্ব রয়েছে।

আলোচনায় স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের ইমেরিটাস অধ্যাপক এম ফিরোজ আহমেদ অভিযোগ করেন, ঢাকা মহানগরের জন্য প্রণীত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) মূলত এই শহরের আশপাশের জলাভূমিগুলোতে আবাসন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়ার জন্য করা হয়েছে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ এস এম কামরুল হাসান বলেন, গত মার্চ, এপ্রিল ও মে থেকে তাপমাত্রা বাড়া শুরু হয়েছে। এবার মৌসুমি বৃষ্টিপাতও তুলনামূলক কম হয়েছে। কারণ হলো, এল নিনো সর্বোচ্চ পর্যায়ে আছে। এটা আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত থাকবে। ফলে আগামী বছরের মার্চ–এপ্রিল মাসও উত্তপ্ত থাকার আশঙ্কা খুবই বেশি। তাপ কমাতে শহরে প্রাইভেটকারের ব্যবহার কমাতে গাড়িমালিকদের ওপরে করারোপের সুপারিশ করেন তিনি।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি বলেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে অনেকগুলো কারণ আছে, যা বেশি চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দেশে যে মডেলে উন্নয়ন হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা দরকার বলে মনে করেন অ্যাকশনএইডের ব্যবস্থাপক মো. আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, আগে বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলা হতো, উন্নয়ন মডেলের বিরুদ্ধে কথা হতো, বিশ্বব্যাংক-এডিবির পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কথা বলা হতো। সেই আলোচনাগুলো স্তিমিত হয়ে গেছে। সেই জায়গায় চলে এসেছে খাপ খাইয়ে নেওয়ার বিষয়গুলো। হিট অফিসার যেসব কথা বলছেন, সেটিও ওই কথা। ঢাকা ছাড়া দেশের সব শহরে একই ধাঁচে উন্নয়ন হচ্ছে, যা তাপমাত্রা বাড়িয়ে তুলছে বলেও মনে করেন তিনি।

স্বাগত বক্তব্যে বৈঠকের আয়োজক সংস্থা বারসিকের সমন্বয়ক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এবার ঢাকার তাপমাত্রা ১৩০ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। এতে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অনেকে মানুষ হিটস্ট্রোকে মারা গেছেন। মানুষ আর আট ঘণ্টা কাজ করতে পারছে না।

বৈঠকে প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের (পিআইবি) মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদসহ অনেকে বক্তব্য দেন। গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন বারসিকের পরিচালক পাভেল পার্থ।