বস্তিতে কমিয়ে ঢাকার অন্য সব এলাকায় পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে একটি পাঁচ তারকা হোটেলে রোববার বিকেলে এলাকাভিত্তিক পানির মূল্য নির্ধারণবিষয়ক টেকনিক্যাল স্টাডির ফলাফল উপস্থাপন অনুষ্ঠানে ঢাকা ওয়াসার পানির নতুন দরের প্রস্তাব তুলে ধরা হয়
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকার বাসিন্দাদের আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী পানির দাম নির্ধারণ করতে চায় ওয়াসা। নিম্ন আয়ের মানুষ, নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত—এই পাঁচ ক্যাটাগরিতে ভাগ করে পানির দাম নির্ধারণের একটি প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি। এর মধ্যে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য প্রতি ১ হাজার লিটার পানির দাম ১২ টাকা ৫০ পয়সা এবং উচ্চবিত্তদের জন্য ৩৭ টাকা ৫০ পয়সা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে আবাসিক গ্রাহকদের জন্য ঢাকা ওয়াসার প্রতি ১ হাজার লিটার পানির দাম ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। ধনী–দরিদ্রনির্বিশেষে সবাইকে এই হারে পানির বিল দিতে হয়।

আজ রোববার বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে একটি পাঁচ তারকা হোটেলে এলাকাভিত্তিক পানির মূল্য নির্ধারণবিষয়ক টেকনিক্যাল স্টাডির ফলাফল উপস্থাপন অনুষ্ঠানে এ প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে। ঢাকা ওয়াসা ও ওয়াটারএইডের যৌথ উদ্যোগে এ গবেষণা করা হয়। তবে প্রস্তাবিত দাম নিয়ে সুবিধাভোগীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বিষদ আলোচনার পর এই দাম চূড়ান্ত করা হবে বলে অনুষ্ঠানে জানানো হয়।

ওয়াসার নতুন প্রস্তাবে প্রতি ১ হাজার লিটার পানির দাম নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্য ১৮ টাকা ৭৫ পয়সা, মধ্যবিত্তদের জন্য ২৫ টাকা, উচ্চমধ্যবিত্তদের জন্য ৩১ টাকা ২৫ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রস্তাব অনুমোদিত হলে উচ্চবিত্তদের প্রতি ১ হাজার লিটার পানি বর্তমান দামের চেয়ে ২২ টাকা ৩২ পয়সা বেশি দিয়ে কিনতে হবে। আর উচ্চমধ্যবিত্তদের ১৬ টাকা ৭ পয়সা, মধ্যবিত্তদের ৯ টাকা ৮২ পয়সা ও নিম্নমধ্যবিত্তদের প্রায় ৪ টাকা বেশি দামে পানি কিনতে হবে। বিপরীতে নিম্ন আয়ের লোকেরা বর্তমান দামের চেয়ে ২ টাকা ৬৮ পয়সা কমে পানি পাবেন।

এ ছাড়া শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রতি হাজার লিটার পানির দাম ৫০ টাকা এবং সরকারি স্থাপনার জন্য ২৫ টাকা নির্ধারণেরও প্রস্তাব করা হয়েছে। বাণিজ্যিক গ্রাহকদের প্রতি হাজার লিটার পানির জন্য বর্তমানে ওয়াসাকে ৪২ টাকা দিতে হয়। ওয়াসার এ প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদেরও বেশি দামে পানি কিনতে হবে। বর্তমানে রাজধানীতে ওয়াসার পানি ব্যবহারকারীদের মধ্যে এই দুই শ্রেণির মানুষ রয়েছেন ৮৩ দশমিক ৪ শতাংশ।

কারিগরি গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করতে গিয়ে ওয়াটারএইডের টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার তাহমিদুল ইসলাম বলেন, এলাকাভিত্তিক দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাঁরা সংশ্লিষ্ট এলাকার মৌজা দর, গৃহকর ও মাসিক আয়কে বিবেচনায় নিয়েছেন। এই তিন বিষয় বিবেচনায় নিয়ে রাজধানীকে ১০টি জোনে ভাগ করেছেন। এর মধ্যে ৫ নম্বর জোনে সবচেয়ে বেশি বিত্তশালী মানুষের বসবাস। এ জোনের মধ্যে গুলশান, বনানী, কারওয়ান বাজার এলাকা পড়েছে। আর ১ নম্বর জোনে নিম্ন আয়ের লোকজন বসবাস করেন। এ জোনের মধ্যে যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ ও গেন্ডারিয়া এলাকা রয়েছে।

রাজধানীর প্রায় দুই কোটি মানুষ ওয়াসার পানি ব্যবহার করছে বলে সেমিনারে জানানো হয়। ওয়াসার হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ৩ লাখ ৬৬ হাজারের বেশি বৈধ পানির সংযোগ রয়েছে। এর মধ্যে নিম্ন আয়ের ২ দশমিক ৯ শতাংশ, নিম্নমধ্যবিত্তদের মধ্যে ৭৯ দশমিক ৪ শতাংশ, মধ্যবিত্ত ৪ শতাংশ, উচ্চমধ্যবিত্ত ১ দশমিক ৩ শতাংশ এবং শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষ ওয়াসার পানি ব্যবহার করছে। এলাকাভিত্তিক পানির মূল্য নির্ধারণ করা হলে সরকার থেকে ওয়াসাকে আর ভর্তুকি নিতে হবে না। উল্টো লাভের মুখ দেখবে ওয়াসা।

পাঁচটি ক্যাটাগরি কীভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়াটারএইডের টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজর তাহমিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-২০০০ অনুযায়ী তাঁরা ক্যাটাগরি ঠিক করেছেন। তিনি বলেন, ২ হাজার ৫০০ বর্গফুটের বেশি আয়তনের বাসায় যিনি থাকেন, তিনি উচ্চবিত্ত, ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ বর্গফুটের বাসায় যিনি থাকছেন, তিনি উচ্চমধ্যবিত্ত, ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ বর্গফুটের বাসায় বসবাসকারীদের মধ্যবিত্ত এবং ১ হাজার বর্গফুটের নিচে বসবাসকারীদের নিম্নমধ্যবিত্ত হিসেবে ধরা হয়েছে। আর বস্তির বাসিন্দাদের নিম্ন আয়ের মানুষ হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছেন তাঁরা।

সেমিনারে ওয়াসার চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা বলেন, দেশের মানুষ আর্থিক সংকটে আছে। তাই বোর্ডের সদস্যরা দাম বাড়ানোর বিপক্ষে। তবে উৎপাদন খরচ যেহেতু বাড়ছে, তাই দাম বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে তাঁরা আলোচনা করছেন।

ওয়াসার যেকোনো কাজ জ্ঞানভিত্তিক হয়ে থাকে দাবি করে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেন, প্রস্তাবিত এই দাম নিয়ে তাঁরা সুবিধাভোগীদের সঙ্গে সভা করবেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গেও আলোচনা করবেন। প্রতিদিন ৫০ কোটি লিটার পানি অপচয় হচ্ছে বলেও জানান ওয়াসার এমডি।

সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, পানির দাম অবশ্যই যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করতে হবে। মানুষের জন্য যেন কষ্টকর না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আবার কম দামে পানি সরবরাহ করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠান যাতে অকার্যকর না হয়, সেদিকটাও লক্ষ রাখতে হবে।

তাজুল ইসলাম বলেন, ভর্তুকি দিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে পারবে না। পানির দাম কত হবে, তা ওয়াসার বোর্ড সভার মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হবে। অযৌক্তিকভাবে পানির দাম যেমন বাড়ানো উচিত নয়, তেমনি যৌক্তিক দাম দিতে অসহযোগিতা করারও সুযোগ নেই। উৎপাদন খরচ কোনোভাবেই বিক্রির চেয়ে কম হতে পারে না। শুধু দাম বাড়লেই প্রতিষ্ঠান লাভজনক হবে না। অব্যবস্থাপনা বা দুর্নীতির কারণে পানির মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা হবে। দুর্নীতিকে কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না।

অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী ও ওয়াটারএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিনা জাহান প্রমুখ বক্তব্য দেন।