জবাবদিহি না থাকায় গাছ কাটা হচ্ছে

‘ধানমন্ডি সাতমসজিদ সড়ক বিভাজকসহ সব বিভাজকে গাছ কাটা বন্ধের দাবিতে’ সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা। সোমবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে
ছবি: সাজিদ হোসেন

নগরে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প নিলে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় মানুষের মতামত নিতে হয়। ধানমন্ডির সাত মসজিদ সড়কে নেওয়া উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে তা করেনি সিটি করপোরেশন। বরং গভীর রাতে সড়ক বিভাজকের গাছগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে। এটা জবাবদিহিহীনতার ফল।

রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে আজ সোমবার ‘ধানমন্ডি সাতমসজিদ সড়ক বিভাজকসহ সব বিভাজকে গাছ কাটা বন্ধের দাবিতে’ সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলা হয়। সাতমসজিদ সড়ক গাছ রক্ষা আন্দোলন এই সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ধানমন্ডির সাতমসজিদ সড়কের সড়ক বিভাজকের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য গাছ কাটছে। এর প্রতিবাদ জানাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। এরই অংশ হিসেবে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, সাতমসজিদ সড়কে যে গাছগুলো কাটা হয়েছে, তার মধ্যে ছিল বট, বকুল, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, শিরীষসহ নানা প্রজাতির দেশীয় গাছ। গত ৩০ জানুয়ারি গাছ কাটার বিরুদ্ধে সাতমসজিদ সড়কে প্রথম মানববন্ধন করা হয়। এরপর গাছ কাটা বেশ কিছুদিন বন্ধ ছিল। গত ৩০ এপ্রিল রাতে আবারও কাছ কাটা শুরু হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যে নথি দেখিয়েছে, সেখানে সৌন্দর্যবর্ধনের কথা বলা হলেও গাছ কাটার বিষয়টি উল্লেখ ছিল না।

সংবাদ সম্মেলন শেষে আন্দোলনকারীরা নগর ভবনে যান ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের কাছে স্মারকলিপি দিতে। তবে মেয়র সে সময় নগর ভবনে ছিলেন না বলে জানান তাঁর সহকারী একান্ত সচিব নাছিরুল হাসান। তিনি স্মারকলিপি মেয়রকে পৌঁছে দেবেন বলে জানান।

পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী সালেহ আহম্মেদ। তিনি বলেন, সাতমসজিদ সড়কের বিভাজক তিন ফুট প্রশস্ত। এর মধ্যে দেয়াল (গাইডওয়াল) করে, মাটি ভরাট করে কাজ করতে হচ্ছে। ফলে গাছগুলো রাখার সুযোগ ছিল না। তিনি বিষয়টি সহজভাবে নেওয়ার অনুরোধ জানান।

এর আগে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সভাপতি ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সব গাছ কেটে ফেলার মতো এমন নৃশংস আচরণ আগে দেখা যায়নি। উন্নয়ন হতে হবে। কিন্তু উন্নয়ন কিসের জন্য? মানুষকে স্বস্তি দেবে, শান্তি দেবে, নিরাপত্তা দেবে, ভালো রাখবে—তেমন উন্নয়ন দরকার। তিনি বলেন, একটা উপায়ের সঙ্গে যখন লক্ষ্যকে গুলিয়ে ফেলা হয়, তখন বুদ্ধিবৃত্তিক অদক্ষতার সৃষ্টি হয়। সাতমসজিদ সড়কেও সেটা হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবেশ রক্ষার জন্য যত নির্দেশনা দিয়েছেন, সেগুলো কীভাবে অমান্য করা হয়, সে প্রশ্ন তোলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী। তিনি সংবাদ সম্মেলনে ধানমন্ডির সাতমসজিদ সড়কে গাছ কাটার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন নাট্যজন মামুনুর রশীদ। তিনি স্মৃতিচারণা করে বলেন, ধানমন্ডিতে অনেক জলাশয়, সবুজ ছিল। এটা ছিল বসবাসের জন্য পরিকল্পিত এক স্বপ্নের এলাকা। কিন্তু এখন সেই এলাকায়ই সাড়ে তেরো শর বেশি বড় রেস্তোরাঁ এবং অসংখ্য ছোট খাবারের দোকান হয়েছে। ধানমন্ডি এখন পুরো বাণিজ্যিক এলাকা হয়ে গেছে।

গাছ কাটার প্রতিবাদ ও নগরবাসীর আহ্বানে দক্ষিণ সিটির ভ্রুক্ষেপ নেই উল্লেখ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘গত পাঁচ দিনে যে তাণ্ডব দেখলাম, তা দায়িত্বজ্ঞানহীন, অসংবেদনশীল নগর প্রশাসনের পক্ষেই সম্ভব। যে নগর প্রশাসন কারও কথা শোনে না, কাউকে পরোয়া করে না। এমন নৃশংস ও নিষ্ঠুর আচরণে নগরবাসী হিসেবে লজ্জিত, দুঃখিত হই।’

দক্ষিণ সিটি গত বছরের সেপ্টেম্বরে সড়কদ্বীপ, ফুটপাত, সড়ক বিভাজকের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ৯ কোটি ৬২ লাখ টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়, যার আওতায় সাতমসজিদ সড়কের সড়ক বিভাজকের উন্নয়নকাজ করা হচ্ছে। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ইতিমধ্যে সড়ক বিভাজকটির প্রায় ৬০০ গাছ কাটা হয়েছে। এখন ৩০ থেকে ৪০টি গাছ আছে। বন বিভাগের বিধিমালায় ব্যক্তিমালিকানাধীন বা সরকারি জমির গাছ কাটার আগে বন বিভাগের অনুমতি নিতে হয়। এখানে তা অনুসরণ করা হয়নি।

সংবাদ সম্মেলনে কেটে ফেলা গাছগুলো স্থানীয় প্রজাতি দিয়ে প্রতিস্থাপন, নগরের বনায়ন, গাছ রক্ষা ও কাটার বিষয়ে বিধিমালা তৈরি, প্রকল্পে করপোরেশনের নগর-পরিকল্পনা বিভাগের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, এলাকাবাসীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত গ্রহণ, উন্নয়নের নামে সবুজ ধ্বংসের কৌশল থেকে সরে আসা এবং প্রকৃতিভিত্তিক পরিকল্পনাকে প্রাধান্য দেওয়ার দাবি জানানো হয়।

লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন লেখক পাভেল পার্থ। সাতমসজিদ সড়ক গাছ রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আমিরুল রাজীবের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন নারীপক্ষের সদস্য শিরীন হক, ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান প্রমুখ।

সংবাদ সম্মেলনে সাতমসজিদ সড়কের ক্রসিং বন্ধের প্রতিবাদও জানানো হয়। বক্তারা বলেন, ক্রসিং বন্ধের কারণে অনেক দূর গিয়ে যানবাহন ঘোরাতে হয়। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে সিটি করপোরেশন তাঁদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। ট্রাফিক বিভাগ মাঠপর্যায়ে কাজ করে। ট্রাফিক বিভাগ সুযোগ পেলে বিষয়টি নিয়ে সুচিন্তিত মতামত দিতে চায়। তিনি আরও বলেন, সাতমসজিদ সড়ক শুধু ধানমন্ডিবাসীই নয়, মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, রায়েরবাজার, হাজারীবাগ, জিগাতলার মানুষকে ব্যবহার করতে হয়। মানুষের চলাচলের জন্য কী করলে ভালো হয়, তা নিয়ে আরও চিন্তা করা যেতে পারে।