‘সবাই ছুটিতে গেলে দায়িত্ব পালন করবে কে?’

যানবাহনের চলাচল স্বাভাবিক ও সুশৃঙ্খল রাখতে ঈদের দিনও দায়িত্ব পালন করতে হয় ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদেরছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর বিজয় সরণি মোড়ে কখনো এক হাত তুলে যানবাহন থামিয়ে দিচ্ছিলেন। আবার অন্য হাত দিয়ে আরেক পাশের যানবাহনগুলোকে মোড় অতিক্রমের সংকেত দিচ্ছিলেন ট্রাফিক পুলিশের কনস্টেবল আলমগীর হোসেন। ঈদে সবার একসঙ্গে ছুটি থাকে না জানিয়ে আলমগীর হোসেন বলেন, ‘সবাই ছুটিতে গেলে দায়িত্ব পালন করবে কে?’

ঈদের দিন আজ বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আরও কথা হয় পান্থপথে বেসরকারি একটি ব্যাংকের এটিএম বুথের নিরাপত্তাকর্মী লিমন বাবুর সঙ্গে। তাঁর বাড়ি দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলায়। তবে দায়িত্বে নিয়োজিত থাকায় তাঁর বাড়িতে যাওয়া হয়নি। সকালে ঈদের জামাত শেষেই প্রথমে বাবার সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেন লিমন। পরে মায়ের সঙ্গেও কথা হয় তাঁর। তাঁদের দোয়া নিয়েছেন, ঈদের পর ছুটি পেলে বাড়িতে যাবেন বলে মাকে সান্ত্বনাও দিয়েছেন।

আমরা যাঁরা ঈদে দায়িত্বে আছি, আমাদেরও প্রিয়জনের সান্নিধ্যে থাকতে মন চায়। কিন্তু হাসপাতালে যাঁরা ভর্তি আছেন, যাঁরা আহত হয়ে আসছেন, তাঁদের ফেলে রেখে তো আমাদের কোনো আনন্দ হয় না। মানুষের সেবাতেই আমাদের ঈদ আনন্দ। এই আনন্দ নিয়েই আমরা কাজ করি।
মোহাম্মদ আলাউদ্দিন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক সার্জন

লিমন বলেন, ‘আমরা দুই বোন, এক ভাই। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। বোনদের আলাদা সংসার। তারা আব্বা-আম্মার কাছ থেকে দূরে থাকে। আমিও চাকরির কারণে ঢাকায় তাদের থেকে দূরে আছি। ঈদে ছুটি পাইনি, তাই বাড়ি যাওয়া হয়নি। আজ সকালে মা মোবাইলে কল করে জানতে চেয়েছে, আমি কী খেয়েছি? দুপুরে কী খাব?’

কনস্টেবল আলমগীর বা নিরাপত্তাকর্মী লিমনদের মতো জরুরি সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক, পুলিশ, বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি খাতে নিয়োজিত কর্মী, সংবাদকর্মী, পরিবহনশ্রমিক, পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ বিভিন্ন পেশার বহু মানুষ আজ ঈদের দিনেও দায়িত্ব পালন করছেন। মা-বাবা, ভাই-বোন, নিকটাত্মীয়, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশীদের রেখে কষ্ট হলেও তাঁরা দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তাঁরা মনে করেন, মানুষের সেবার জন্য তাঁরা দায়িত্ব পালন করছেন। আর এই সেবার মাধ্যমেই তাঁরা ঈদের আনন্দ উপভোগ করছেন।

বেলা ১১টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, জরুরি বিভাগে চিকিৎসকেরা বিভিন্ন দুর্ঘটনা ও অন্য সমস্যা নিয়ে আসা রোগীদের সেবা দিচ্ছেন। বিভিন্ন রোগের ওয়ার্ডগুলোতে দায়িত্ব পালনকারী চিকিৎসক, নার্স ও মেডিকেলকর্মীদের রোগীদের সেবায় ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে।

বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম বুথের নিরাপত্তাকর্মীরা ঈদের দিনও দায়িত্ব পালন করছেন
ছবি: প্রথম আলো

ঢাকা মেডিকেলের মূল ভবনের নিচতলায় নিউরো সার্জারির (পুরুষ) ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইনচার্জের দায়িত্বে ছিলেন আলতাফ হোসেন। তিনি বলেন, ‘ঈদে ছুটি কাটাতে কার না ভালো লাগে? কিন্তু সবাই একসঙ্গে ছুটিতে গেলে রোগীর সেবা কে করবে। রোগীরাও ঈদে হাসপাতালের বিছানায় পড়ে আছেন। তাঁদের সঙ্গেই আমাদের ঈদ।’

নিউরো সার্জারির ওই ওয়ার্ডে ৫৩ জন রোগী ভর্তি আছেন। তাঁদের সেবায় দায়িত্ব পালন করছেন পাঁচজন নার্স। তাঁদের একজন অঞ্জলি মজুমদার। তিনি ১০ বছর ধরে এই পেশায় আছেন। অঞ্জলি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত বছর চাকরিজীবনে একবারও ঈদের ছুটি কাটাতে পারিনি। প্রয়োজনে অতিরিক্ত সময় দায়িত্ব পালন করি।’

শুধু যে হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সরা রোগীদের সেবা দিচ্ছেন তা নয়, ঈদের আনন্দ নেই হাসপাতালের রোগী ও তাঁদেরর স্বজনদের মধ্যেও। কোনো না কোনো দুর্ঘটনা কিংবা অসুখে আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিয়ে অনিশ্চয়তা ও উৎকণ্ঠায় স্বজনদের দিন কাটছে।

চিকিৎসক, নার্স ও অন্য কর্মীদের ঈদ ছুটিতেও রোগীদের সেবায় নিয়োজিত থাকতে হয়
ছবি: প্রথম আলো

ঈদের দুই দিন আগে গত মঙ্গলবার বাসের ধাক্কায় মাথায় গুরুতর আঘাত পাওয়া লক্ষ্মীপুরের রাশেদ আলীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। রাশেদের অবস্থা সংকটাপন্ন। চিকিৎসকেরা রাশেদকে আইসিইউতে নিতে বলেছিলেন। কিন্তু পরিবারের আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় বাইরে কোনো বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউর ব্যবস্থা করা যায়নি।

রাশেদের চাচাতো ভাই আমিনুল ইসলাম বলেন, ঘটনার দিন রাত সাড়ে ১২টার দিকে কাজ শেষে রাশেদ হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন। তখন একটি যাত্রীবাহী বাস রাশেদকে পেছনে থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে রেখে চলে যায়। রাশেদের দুর্ঘটনায় তাঁদের ঈদ কাটছে হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করেই বলে জানান তিনি।

যানবাহনের চলাচল স্বাভাবিক ও সুশৃঙ্খল রাখতে ঈদের দিনও দায়িত্ব পালন করতে হয় ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের। আজ রাজধানীর বিজয় সরণি মোড়ে যানবাহন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে ছিলেন ট্রাফিক পুলিশের কনস্টেবল আলমগীর হোসেন। কখনো এক পাশের হাত উঁচিয়ে যানবাহন থামিয়ে অন্য হাত দিয়ে আরেক পাশের যানবাহনগুলোকে মোড় অতিক্রমের সংকেত দিচ্ছিলেন তিনি। ঈদের ছুটিতে সড়কে যানবাহন তুলনামূলক কম থাকলেও একেবারে বসে থাকার সুযোগ ছিল না ওই মোড়ে দায়িত্ব পালনকারী ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক সার্জন মোহাম্মদ আলাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যাঁরা ঈদে দায়িত্বে আছি, আমাদেরও প্রিয়জনের সান্নিধ্যে থাকতে মন চায়। কিন্তু হাসপাতালে যাঁরা ভর্তি আছেন, যাঁরা আহত হয়ে আসছেন, তাঁদের ফেলে রেখে তো আমাদের কোনো আনন্দ হয় না। মানুষের সেবাতেই আমাদের ঈদ আনন্দ। এই আনন্দ নিয়েই আমরা কাজ করি।’

এদিকে সংবাদপত্রের ছাপা সংস্করণ বন্ধ থাকলেও ঈদের দিন টেলিভিশন, অনলাইন নিউজপোর্টালের মতো সংবাদমাধ্যমগুলো চালু রয়েছে। ফলে গণমাধ্যমকর্মীদেরও একটা অংশ সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনের কাজ করছে। ঈদের ছুটিতে কাজ করছেন শহর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার কাজে নিয়োজিত কর্মীরাও।