ঢাকার যে সড়কে ‘যুদ্ধ’ করে হাঁটতে হয়

  • দক্ষিণখানের প্রধান সড়কের প্রায় পৌনে দুই কিলোমিটার অংশে ছয় মাস ধরে যান চলাচল বন্ধ।

  • এই বর্ষায় ভোগান্তি আরও বাড়বে, উন্নয়ন কাজের ধীরগতি নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষোভ।

নালা নির্মাণের জন্য খুঁড়ে রাখা হয়েছে সড়ক। কোনো কোনো অংশে হাঁটার জায়গাও নেই। সড়কের খুঁড়ে রাখা অংশে নালার নোংরা পানি জমে মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়েছে। গতকাল রাজধানীর দক্ষিণখানের প্রধান সড়কেছবি: সাজিদ হোসেন

ছয় মাসের বেশি সময় ধরে রাজধানীর দক্ষিণখানের প্রধান সড়কে যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, সড়কের বিভিন্ন অংশে ঠিক মাঝ বরাবর খুঁড়ে রাখা হয়েছে। সেখানে নালা নির্মাণের কাজ চলছে। পরিস্থিতি এমন যে সড়কের কোনো কোনো অংশে হাঁটার জায়গাটুকুও এখন নেই। সড়কের খুঁড়ে রাখা অংশে নালার নোংরা পানি জমে মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়েছে।

উত্তরা-২ নম্বর সেক্টর সংলগ্ন কসাইবাড়ি রেল ক্রসিং থেকে দক্ষিণখান পেরিয়ে উত্তরখানের কাচকুরা পর্যন্ত এই সড়ক সোয়া পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ। এর মধ্যে কসাইবাড়ি রেল ক্রসিং থেকে দক্ষিণখানের মধুবাগ পর্যন্ত অংশের (এস এম মোজাম্মেল হক সড়ক) প্রায় পুরোটা বিধ্বস্ত অবস্থায় রয়েছে। এই পথের দূরত্ব প্রায় পৌনে দুই কিলোমিটার।

কখনো নোংরা পানিতে পা ডুবিয়ে, কখনো মাটির স্তূপ ডিঙিয়ে চলতে হচ্ছে দক্ষিণখানের বাসিন্দাদের।

স্থানীয় বাসিন্দাদের কখনো নোংরা পানিতে পা ডুবিয়ে, আবার কখনো নর্দমা নির্মাণের জন্য খনন করে ফেলে রাখা মাটির স্তূপ ডিঙিয়ে চলতে হয়। এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন নারী, শিশু ও বয়স্ক মানুষেরা। স্থানীয়দের কেউ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে হাসপাতালে নিতে চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হয় স্বজনদের।

প্রেমবাগান এলাকার বাসিন্দা আকলিমা খাতুন বলেন, ‘কয়েক মাস ধরে আমরা চলাফেরা করতে গিয়ে কী কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, সেটি কেউ চিন্তাও করতে পারবে না। রাস্তা কেটে এমন অবস্থা করে রাখছে যে হাঁটার জায়গা পর্যন্ত নাই।’

দক্ষিণখান থেকে অসংখ্য শিক্ষার্থী উত্তরার বিভিন্ন সেক্টরে থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে, যেমন রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, উত্তরা হাইস্কুল, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, নওয়াব হাবিবুল্লাহ উচ্চবিদ্যালয় এবং আকিজ ফাউন্ডেশন স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ে। এসব শিক্ষার্থীর স্কুলে যাতায়াত বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। শিক্ষার্থীদের রীতিমতো যুদ্ধ করে এক থেকে দেড় কিলোমিটার সড়ক পার হতে হচ্ছে। এই ভোগান্তি প্রতিদিনের। ঢাকা উত্তর সিটির চারটি ওয়ার্ডের প্রায় পাঁচ লাখ বাসিন্দা দক্ষিণখান এলাকায় থাকেন।

মাটির উঁচু-নিচু স্তূপ ডিঙিয়ে দুর্ভোগের সঙ্গে ঝুঁকি নিয়েও পথ চলতে হচ্ছে স্থানীয় লোকজনকে।
ছবি: সাজিদ হোসেন

মানুষের অবস্থা এখন এমন হয়েছে যে বৃষ্টি হলে ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ রাখতে হয় বলে প্রথম আলোকে বলেন দক্ষিণখানের আইনুসবাগের বাসিন্দা হেলেনা জাহিদ। তাঁর দুই ছেলের একজন রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে, অন্যজন আকিজ ফাউন্ডেশন স্কুলে পড়ে।

দক্ষিণখান এলাকার প্রধান সড়ক এস এম মোজাম্মেল হক সড়কের প্রেমবাগান মোড় থেকে কাজীবাড়ি মোড় পর্যন্ত অংশের দূরত্ব প্রায় আধা কিলোমিটার। সড়কের এই অংশে নর্দমা নির্মাণের কাজ শেষ। তবে সড়কের খনন করা অংশ ভরাট করা হয়নি। এ কাজটুকু হলে মানুষ অন্তত হেঁটে চলতে পারতেন। কিন্তু ওই অবস্থাতেই দীর্ঘদিন ধরে সড়কটি ফেলে রাখা হয়েছে।

গত শুক্রবার দক্ষিণখান এলাকার প্রধান সড়কের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখেন এই প্রতিবেদক। সরেজমিনে দেখা যায়, কোথাও কোথাও সড়কের মাঝে খনন করে রাখা অংশে পয়োবর্জ্যের নোংরা পানি জমে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। সেই পানিতে ভাসছে ময়লা-আবর্জনা। স্থানীয় বাসিন্দারা সড়কের কোথাও কংক্রিটের টুকরাভর্তি সিমেন্টের বস্তা ফেলে, কোথাও ইট বা কাঠের টুকরা বিছিয়ে আবার কোথাও লোহার পাত ফেলে কোনোরকমে হাঁটার ব্যবস্থা করেছেন। উন্নয়ন কাজের ধীরগতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

সড়কের কসাইবাড়ি রেলক্রসিং থেকে প্রেমবাগান মোড় পর্যন্ত প্রায় ৭০০ মিটার অংশে নর্দমার পাইপ বসাতে খনন করা মাটি সড়কের দুপাশে ফেলে রাখা হয়েছে। মাটির উঁচু-নিচু স্তূপ ডিঙিয়ে দুর্ভোগের সঙ্গে ঝুঁকি নিয়েও পথ চলতে হচ্ছে স্থানীয় লোকজনকে।

ঢাকা উত্তর সিটির প্রকৌশল বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কসাইবাড়ি থেকে শুরু হওয়া দক্ষিণখানের প্রধান সড়কে নর্দমা নির্মাণের কাজ ৭১ ভাগ শেষ হয়েছে। অন্যদিকে সড়ক সংস্কারের কাজ শেষ হয়েছে ৪২ ভাগ।

ঢাকা উত্তর সিটির ১৮টি ওয়ার্ডে চলমান সড়ক ও নর্দমা উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক খন্দকার মাহবুব আলম গতকাল রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, পুরো প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৪২ শতাংশ। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে নর্দমা নির্মাণের কাজ শেষ হবে। নভেম্বরের মধ্যে সড়কের সংস্কার কাজও শেষ হয়ে যাবে।

ছয় মাসের বেশি সময় ধরে রাজধানীর দক্ষিণখানের প্রধান সড়কে যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।
ছবি: সাজিদ হোসেন

প্রকল্পের পরিচালকের এই বক্তব্যেই স্পষ্ট যে আসছে বর্ষা মৌসুমে রাজধানীর দক্ষিণখান ও উত্তরখান এলাকার বাসিন্দাদের ভোগান্তির মধ্যেই থাকতে হবে।

নগর–পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মুহম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, উন্নয়ন কাজের নিয়মই হচ্ছে এলাকাবাসীর ভোগান্তির বিষয়টি মাথায় রাখা। সড়ক খননের নীতিমালাতেও বলা আছে এলাকাবাসী অন্তত যেন হাঁটাচলা করতে পারে, সেই জায়গার ব্যবস্থা করা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে যখন সড়কে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলে, তখন ধরেই নেওয়া হয় মানুষের দুর্ভোগ হবেই। কী করলে জনগণের দুর্ভোগ সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব, সেটি সিটি করপোরেশনসহ কোনো সরকারি সংস্থাই আসলে বিবেচনায় নিতে চায় না।