কাঠমিস্ত্রি মেহেদীর গান মুগ্ধ করে অন্যদের
কাঠের মধ্যে ফুল, লতাপাতার নকশা করছিলেন মেহেদী হাসান। আর গলা ছেড়ে গাইছেন ‘দয়াল রে, তুই বুঝি আর দুঃখ দেবার মানুষ পেলি না...’, বাড়ির কাছে আরশিনগর...’, ‘মেরা মেহবুব আয়া হ্যায়...’, ‘মেরা জীবন কোরা কাগজ,/ কোরা হি রাহে গ্যায়া...’। নজরুলগীতি, রবীন্দ্রসংগীত—যখন যেটা মনে আসছে, সেটাই গাইছেন।
মেহেদী হাসানের পাশে বসে গান শুনছিলেন মিজানুর রহমান, মো. আমজাদসহ মেহেদী হাসানের খালাতো ভাইসহ স্বজন ও সহকর্মীরা। একজন বললেন, ‘কিশোর কুমারের গানের এক কলি গাও।’ আরেকজনের আবার আবদার হিন্দি গানের। আবদার মেটাতে মেটাতে একসময় মেহেদী জানিয়ে দিলেন, তিনি আর গান গাইবেন না। এতে গানের শ্রোতা-দর্শকেরা খানিকটা বেজারও হলেন।
বুধবার রাজধানীর কাজীপাড়ায় গিয়ে মেহেদী হাসানকে ঘিরে এ আয়োজন দেখা গেল। তাঁরা কাজের ফাঁকে প্রায়ই মেহেদীর গান শোনেন। ছোট এক গলিতে প্রায় ৩০ জন কাঠের কাজ করেন। ছোট ছোট ঘরে চার থেকে পাঁচজন করে কাজ করেন। অন্ধকার ঘর, কাঠ কাটাসহ বিভিন্ন যন্ত্রের শব্দ, গরম—এ পরিবেশেই কাজ করেন মেহেদীসহ কাঠের এই মিস্ত্রিরা।
গায়ক হিসেবে সহকর্মীদের কাছে মেহেদীর কদরটা একটু বেশি। একজন বললেন, ‘মেহেদীর গান শুনলে গায়ে কেমন যেন কাঁটা দিয়ে ওঠে। কিশোর কুমার থেকে শুরু করে সব শিল্পীর গান গাইতে পারেন মেহেদী।’
গান শেখার ক্ষেত্রে ৩৮ বছর বয়সী মেহেদী হাসানের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো প্রশিক্ষণ নেই। নেই কোনো বাদ্যযন্ত্র। ছোটবেলা থেকেই গানের নতুন কোনো ক্যাসেট বের হলে, যেকোনো উপায়ে তা কিনতেন। তারপর তা বাজিয়ে শুনে শুনেই পছন্দের গান মুখস্থ করে ফেলতেন। এভাবে কত গান যে মুখস্থ, তা মেহেদী নিজেও জানেন না। সুর করে গাইলেন ‘অগ্নিবীণার ঝংকারে ফোটা তুমি আগুনের ফুল, তোমারই গানের ফুল দিয়ে পূজা করি, কবি নজরুল, কবি নজরুল...’ এমন গানের মধ্যে ডুব দিতে তিনি বেশি ভালোবাসেন বলেও জানিয়ে দিলেন।
কাজীপাড়ায় গলির মুখে ছোট একটি গেট দিয়ে ঢুকলে প্রথম ঘরটাই মেহেদীর। ঘরের এক কোণে কাঠের স্তূপ, পরিত্যক্ত কাঠের আবর্জনা, দু–একটা সিগারেটের খালি প্যাকেট ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। দড়িতে ঝুলছে রং চটে যাওয়া কিছু কাপড়। কাঠের ছোট এক আলমারিতে রাতে মেঝেতে বিছিয়ে ঘুমানোর কম্বলসহ টুকটাক জিনিস। ঘরে একটি ফ্যান আছে। দেয়ালে ছোট ভাঙা একটি আয়না, চিরুনি আর একটি ব্রাশ। এই হলো মেহেদীর সংসার। এ ঘরে বসে মেহেদী চোখ বন্ধ করে যখন গান গাইতে শুরু করেন, তখন তিনি ভিন্ন এক মানুষ। তখন তিনি পুরোদস্তুর শিল্পী।
জীবন-জীবিকার তাগিদে ১৯৯৮ সালে ফরিদপুর থেকে ঢাকায় চলে এসেছিলেন মেহেদী। মন খুব খারাপ হলে বা মাঝেমধ্যে মনের আনন্দে কাজের ফাঁকে গানের চর্চা করেন মেহেদী। নিজে গান লেখেন এবং তাতে সুরও দেন। ভবিষ্যতে কখনো টাকা হলে নিজের লেখা গানগুলো তিনি প্রকাশ করবেন। তাই তাঁর লেখা নতুন গান কাউকে শোনান না মেহেদী।
শাহিনা ইয়াসমীন নামের এক নারীর মাধ্যমে ফেসবুকে মেহেদী হাসান বেশ পরিচিতি পেয়েছেন। গত ৩০ জানুয়ারি শাহিনা ইয়াসমীন ফেসবুকে একটি পোস্টে জানিয়েছেন, শাহিনা ইয়াসমীনের পাশের বাসায় দরজার পাল্লা লাগানোর কাজে গিয়েছিলেন মেহেদী। সে সময় মেহেদী কাজের ফাঁকে একটার পর একটা গান গাইছিলেন। তা শুনে শাহিনা মুগ্ধ হন এবং মেহেদীকে আরেকটি গান গাইতে বলেন। তখন শাহিনা তাঁর বাসার জানালার পাশে দাঁড়িয়ে তা ভিডিও করেন। তিনি গানটি ফেসবুকে শেয়ার করলে ভালো সাড়া পান (গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১৯ লাখ ভিউ)। কেউ যদি সাহায্য করতে চান, তাই শাহিনা ইয়াসমীন মেহেদীর মুঠোফোন নম্বরও দিয়ে দেন ফেসবুকে।
ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া প্রসঙ্গে মেহেদী হাসান শাহিনা ইয়াসমীনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। ভাইরাল হওয়ার পর ইউটিউবারসহ কেউ কেউ নিজেদের ব্যবসার জন্য যোগাযোগ করে মেহেদীকে গান গাওয়ার জন্য অনুরোধও জানিয়েছেন। একজনের জন্য গান গেয়েছিলেনও। তবে পরে আর ওই লোকের খোঁজ পাননি মেহেদী। তাই তিনি আর এ ধরনের ফাঁদে পা দেবেন না বলে জানালেন। তবে শুধু প্রথম আলো গান গাইতে বলেছে বলেই গান শুনিয়েছেন বলেও প্রতিবেদককে জানিয়ে দিলেন।
মেহেদী হাসানের স্ত্রী রুবিয়া বেগম দুই ছেলে–মেয়েকে নিয়ে ফরিদপুরের মধুখালীর রুকুনী গ্রামে থাকেন। নবম শ্রেণিতে পড়ছে ছেলে। মেয়ে পড়ছে চতুর্থ শ্রেণিতে। মেহেদী দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। মেহেদীর বাবা কৃষিকাজ করেন। মেহেদী জানালেন, তাঁর বাবা গান গাইতে পছন্দ করতেন। ছয় ছেলে, দুই মেয়ের বিশাল সংসার সামলে গান গাওয়ার বিলাসিতা দেখাতে পারেননি। তবে মেহেদী বা অন্য ছেলেমেয়েদের ছোটবেলায় ঘুম পাড়ানোর সময় বাবা গান গাইতেন। সেই তখন থেকেই মেহেদীর মনের মধ্যে গানের সুর ঢুকে যায়।
কাঠমিস্ত্রির কাজ করে মেহেদী হাসানের মাসে আয় খুব বেশি হলে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। তাই স্ত্রী–সন্তানকে ঢাকায় কাছে এনে রাখতে পারেন না। বাড়িতে একটু কৃষিজমি আছে, গরু-ছাগল আছে, তা দেখার জন্যও স্ত্রীকে গ্রামে থাকতে হচ্ছে। আর শহরের স্কুলে ছেলে–মেয়েকে পড়ানোর ক্ষমতাই তো নেই। আয় করা টাকা থেকে মাসে নিজের ঘরভাড়া ও খাবারে লাগে আট হাজার টাকা। বাড়িতে ১০ হাজার টাকা পাঠাতে হয়। তারপর তো হাত খালি।
মেহেদী হাসান বললেন, গান গাইতে হলে টাকার প্রয়োজন। খালি গলায় তো আর গান হয় না। বাদ্যযন্ত্র লাগে। ভালো সংগীত পরিচালক লাগে। গানের কম্পোজিশন করতে হয়। গলায় সুর ছাড়া এসব মেহেদীর কিছুই নেই। আর ছোটবেলা থেকে গান গাওয়ার জন্য অনেক ধরনের নির্যাতনেরও শিকার হতে হয়েছে। গ্রামের মানুষ গান গাওয়াকে তেমন ভালো চোখে দেখতেন না। পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকেও বাধা পেতে হয়েছে। কোনো অনুষ্ঠানে গান গাইতে গেলে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মেহেদী দেখতেন, হয় বাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেছে, নয়তো সেদিনের খাবার বন্ধ। তাঁর ভাষায়, ‘এভাবে তো আর গান হয় না। গানের জন্য পৃষ্ঠপোষকতা লাগে।’
প্রথম আলোকে অনেকগুলো গান শোনানোর পর তাঁর পছন্দের গান কোনটি জানতে চাইলে জানালেন, ‘মেরা জীবন কোরা কাগজ,/ কোরা হি রাহে গ্যায়া...’ গানটি তাঁর খুব পছন্দের গান।
তবে নিজেই আবার বললেন, রাজার ভূমিকায় কেউ যখন অভিনয় করেন, তখন তিনি নিজেকে রাজাই মনে করেন। তেমনি মেহেদী হাসান যখন গানের মধ্যে ডুবে যান, তখন তিনি নিজেকে একজন শিল্পীই মনে করেন, ভুলে যান তিনি একজন কাঠমিস্ত্রি।