এক.
২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে পুরোনো গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারভিডার তখনকার সভাপতি আবদুল হকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ঢাকার বাস দেখলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে কোন পর্যায়ে আছে বলে মনে হয়—দরিদ্র, মধ্যম আয়, নাকি উন্নত?
আবদুল হক পৃথিবীর অনেক দেশ ঘুরেছেন। নিজেও গাড়ির ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছর হতে যাচ্ছে। আমার অত্যন্ত বেদনা বোধ হয় এবং লজ্জা লাগে। এটাই কি আমাদের নিয়তি ছিল?’
ইতিমধ্যে স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার কমেছে, জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) বেড়েছে, সামাজিক নানা সূচকে আমাদের বড় অর্জন আছে। আমরা ‘এশিয়ান টাইগার’ অভিধাও পেয়েছি। কিন্তু এত সুনাম শুনে যদি কোনো বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশে আসেন, ঢাকায় নেমে রাজধানীর বাসগুলো দেখেন, তাহলে তিনি কী ভাববেন? আমার ধারণা, তিনি ভাববেন, বাংলাদেশ একটি দরিদ্র দেশ অথবা এই দেশে আইনকানুন বলে কিছু নেই।
বাংলাদেশ দরিদ্র দেশ নয়, সেটা আমরা জানি। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণপর্ব চলছে। বিশ্বব্যাংক আগেই বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশে আইনকানুনও আছে। সড়ক পরিবহন আইনের ২৫ ধারায় বলা আছে: (১) মোটরযানের ফিটনেস সনদ ব্যতীত বা মেয়াদ উত্তীর্ণ ফিটনেস সনদ ব্যবহার করিয়া, বা ইকোনমিক লাইফ অতিক্রান্ত বা ফিটনেসের অনুপযোগী, ঝুঁকিপূর্ণ বা ক্ষতিগ্রস্ত, রংচটা, কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত নির্ধারিত রং পরিবর্তন করিয়া জরাজীর্ণ, বিবর্ণ বা পরিবেশ দূষণকারী কোনো মোটরযান চালনা বা চালনার অনুমতি প্রদান করা যাইবে না। (২) উপধারা (২)-এর বিধান অনুযায়ী ফিটনেসের অনুপযোগী কোনো মোটরযানের ক্ষেত্রে ফিটনেস সনদ প্রদান করা হইলে সনদ প্রদানকারী কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে।
আইনকানুন থাকলেও বাংলাদেশের যা নেই, তা হলো আইনের প্রয়োগ। আইন প্রয়োগের জন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) নামে এক সংস্থা ও ট্রাফিক পুলিশ আছে। কিন্তু সবার চোখের সামনে দিয়ে খোদ রাজধানী শহরে ফিটনেসবিহীন, লক্কড়ঝক্কড়, রংচটা, রুট পারমিটহীন বাস চলাচল করছে, তা তারা দেখে না। চোখ এড়িয়ে যায় কীভাবে, তারা কি টিনের চশমা পরে থাকে?
দুই.
বিআরটিএর কর্মকর্তারা যদি টিনের চশমা পরে থাকেন, তাঁদের সেই চশমা খোলার জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় রয়েছে। সেই মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে ১ জন সচিব, ৫ জন অতিরিক্ত সচিব, ৭ জন যুগ্ম সচিব ও ১১ জন উপসচিব রয়েছেন। সচিবেরা চশমা খোলার কাজটি করতে পারছেন কি না, তা তদারকির জন্য আওয়ামী সরকারের মন্ত্রিসভার সবচেয়ে প্রভাবশালী মন্ত্রী রয়েছেন, যিনি ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
ওবায়দুল কাদের ২০১১ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী। আগামী ৫ ডিসেম্বর এই মন্ত্রণালয়ে তাঁর ১১ বছর পূর্ণ হবে। এ সময়ে পদ্মা সেতু চালু হয়েছে, মেট্রোরেলের কাজ এগিয়েছে, সড়কে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু ঢাকার লক্কড়ঝক্কড় বাস দূর করতে, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে, বিআরটিএর দুর্নীতি দূর করতে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। অবশ্য সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ঢাকায় রংচটা ও লক্কড়ঝক্কড় বাস নিয়ে একাধিকবার উষ্মা প্রকাশ করেছেন, নির্দেশ দিয়েছেন।
যেমন ২০১৮ সালের আগস্টে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে ওবায়দুল কাদের বলেন, ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ঢাকা মহানগরীতে চলাচলরত সব বাস রং করে ঝকঝকে করতে হবে। মালিকপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই নির্দেশের পর চার বছর কেটেছে। কিন্তু ঢাকার বাসের হাল আগের মতোই রয়ে গেছে।
এমন যখন পরিস্থিতি, তখন ঢাকাবাসীর মনে আশা জাগিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। তিনি নতুন ৪ হাজার বাস নামানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেটা ২০১৫ সালে। অবশ্য তিনি কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। ২০১৭ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। এরপর দায়িত্বটি নেন ঢাকা দক্ষিণ সিটির তখনকার মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। তিনি কাজটি করবেন বা পারবেন, সে আশা একবারের জন্যও করিনি।
সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আগেও এমন ঘোষণা দিয়েছিলেন। ২০১১ সালে দিয়েছিলেন, ২০১৪ সালেও দিয়েছিলেন। কাজ কিছুই হয়নি।
আমরা জানি, পরিবহনবিষয়ক সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাদের হাতে। আবার বাসমালিকদের অনেকেই আওয়ামী লীগ নেতা।
প্রভাবশালী এমন গোষ্ঠীকে বাগে এনে কাজ করার জন্য প্রয়োজন আরও বড় রাজনৈতিক শক্তি। সেটি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের থাকা উচিত ভাবাটা অপ্রত্যাশিত হবে না।
কিন্তু আমরা দেখছি, বাসমালিকেরা ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশনা মেনে বাস রং করার জন্য ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা ব্যয় করতেও রাজি নন। অথচ তাঁরা ভাড়া বাড়ানোর সময় নানা খাতে ব্যয় দেখিয়ে ওবায়দুল কাদেরের মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বিআরটিএর মাধ্যমে জনগণের পকেট কাটার সুযোগ করে নেন। যেমন ভাড়া নির্ধারণের সময় ঢাকার বাসগুলোর আয়ুষ্কাল দেখানো হয় ১০ বছর। অথচ এসব বাস এর চেয়ে অনেক বেশি পুরোনো। বাসচালক ও পরিবহনশ্রমিকদের নাকি উৎসব ভাতা দেন মালিকেরা! সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, এই বাসের সংস্কার ও সাজসজ্জায় নাকি পাঁচ বছর পরপর সাড়ে ছয় লাখ টাকা করে ব্যয় করা হয়!
খুব অবাক লাগে এটা ভেবে যে মাননীয় মন্ত্রী যখন ঢাকার রাস্তা দিয়ে চলাচল করেন, এসব বাস কি দেখেন না, তাঁর কি মনে হয় না বাংলাদেশের উন্নয়নের যে বিজ্ঞাপন তাঁর সরকার প্রচার করে, সেটার বিপরীত চিত্রই তুলে ধরে ঢাকার বাস।
তিন.
২০১৬ সালে ঢাকার জন্য করা সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (আরএসটিপি) সমীক্ষা অনুযায়ী, রাজধানীর মানুষ দিনে যত যাতায়াত করে (ট্রিপ), এর ৭২ শতাংশই বাস-মিনিবাসে। এই বাস-মিনিবাসে চলাচল করা কত কষ্টকর, তা যাত্রীমাত্রই জানে। নারীদের নিয়মিত হয়রানির শিকার হতে হয় এসব বাসে। যাত্রীদের ভাড়া নিয়ে প্রতিনিয়ত বচসায় লিপ্ত হতে হয় শ্রমিকদের সঙ্গে।
এমন যখন পরিস্থিতি, তখন ঢাকাবাসীর মনে আশা জাগিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। তিনি নতুন ৪ হাজার বাস নামানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেটা ২০১৫ সালে। অবশ্য তিনি কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। ২০১৭ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। এরপর দায়িত্বটি নেন ঢাকা দক্ষিণ সিটির তখনকার মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। তিনি কাজটি করবেন বা পারবেন, সে আশা একবারের জন্যও করিনি।
২০২০ সালের মে মাসে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেন শেখ ফজলে নূর তাপস। উত্তরে দায়িত্ব পান আতিকুল ইসলাম। শেখ ফজলে নূর তাপস বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির আহ্বায়ক, আতিকুল ইসলাম সদস্য। ২০২১ সালের ২৮ নভেম্বর এই কমিটির এক সভায় শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘ঢাকাবাসীকে জিম্মি করে এই অরাজকতা দিনের পর দিন চলবে না। আই উইল মেক ইট হ্যাপেন (আমি এটা করে দেখাব)।’
২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে কেরানীগঞ্জ-ঘাটারচর রুটে ঢাকা নগর পরিবহনের বাস চালু হয়। এই বাসে ভাড়া বেশি নেওয়া হয় না, যাত্রীদের ‘লড়াই’ করে বাসে উঠতে হয় না, বাস চলাচলে প্রতিযোগিতা হয় না। অবশ্য এই রুটে অন্য বাস চলছিল আগের মতোই। অনেকগুলোরই রুট পারমিট ছিল না। পরে দেখা গেছে, মালিকেরা ঢাকা নগর পরিবহনের অধীন বাস চালাতে আগ্রহী নন। সেবাটি খুব একটা সফল হয়েছে, তা বলা যাবে না।
ঢাকায় ১ সেপ্টেম্বর থেকে ঘাটারচর-ডেমরা, ঘাটারচর-চিটাগং রোড ও ঘাটারচর-কদমতলী রুটে ঢাকা নগর পরিবহনের বাস নামানোর কথা ছিল। সেটা সম্ভব হয়নি।
বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির ৬ সেপ্টেম্বরের সভা শেষে শেখ ফজলে নূর তাপস সাংবাদিকদের বলেন, জাহান এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের অসহযোগিতার কারণে একটি রুটে বাস নামানো সম্ভব হয়নি। বাকি দুটি রুটের যেসব বাস নামানোর কথা ছিল, সেগুলো এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত করা যায়নি। তাই দুই রুটে ১৩ অক্টোবর থেকে ঢাকা নগর পরিবহনে বাসসেবা চালু হবে। আর অন্য রুটটিতে বাস নামানোর জন্য আগামী ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা ঠিক করা হয়েছে।
দেখা যাচ্ছে, দুই মেয়র খুব একটা সফল হতে পারছেন না। ঢাকা নগর পরিবহন কোম্পানির অধীন বাস চালাতে মালিকদের আগ্রহ নেই। কারণ সেখানে যথেচ্ছাচারের সুযোগ নেই। একই পথে ঢাকা নগর পরিবহনের বাইরের বাসে যথেচ্ছাচারের অবারিত সুযোগ।
দুই মেয়রকে সহযোগিতা করতে পারত বিআরটিএ ও পুলিশ। তারা যদি সংশ্লিষ্ট রুটে বাড়তি ভাড়া আদায় ও রুট পারমিটহীন বাস চলাচল বন্ধে ধারাবাহিক অভিযান চালাত, তাহলে ঢাকা নগর পরিবহন সফল হতো। সেই সদিচ্ছা কই!
চার.
প্রতিটি বাস কিনতে ৩০ লাখ টাকা ঋণ ধরে ঢাকায় চার হাজার বাস নামাতে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার একটি তহবিল হলেই হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণের জন্য এই তহবিল দিতে পারে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এই চার হাজার বাস আমদানির জন্য শুল্ক কমিয়ে দিতে পারে। সমন্বিত উদ্যোগ নিতে পারেন সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি একটি প্রস্তাব নিয়ে গেলে সরকারপ্রধান ‘না’ করে দেবেন না নিশ্চয়ই।
কিন্তু সেটা হয় না। হয়তো হবেও না। কেন হবে না, তার একটা কারণ উল্লেখ করেছেন বিবিসি বাংলার সাংবাদিক আকবর হোসেন। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশে সিস্টেম গড়ে ওঠে না কেন? সুশাসন কেন হয় না? এটা বোঝার জন্য কোনো বুদ্ধিজীবী বা বিশ্লেষক হওয়ার দরকার নেই। ঘটনা খুবই সিম্পল (সাধারণ)। কারণ ক্ষমতাবানেরা তাঁদের জন্য আলাদা সিস্টেম করে রেখেছেন। বিমানবন্দরে ভিআইপি টার্মিনাল, বিদেশে চিকিৎসা নেওয়া এবং ঢাকার বাসের কথা উল্লেখ করে তিনি আরও লিখেছেন, ঢাকা শহরে যেসব লক্কড়ঝক্কড় বাস চলাচল করে, সেটা পৃথিবীর অন্য সভ্য দেশে চলে না। কারণ ক্ষমতাবানেরা এসব বাসে যাতায়াত করেন না। যদি করতেন, তাহলে এ ধরনের পরিস্থিতি থাকত না।
ঢাকার রংচটা ও জীর্ণ বাসগুলো রং করা নিয়ে ২০১১, ২০১৪, ২০১৮ সালে সড়ক পরিবহনমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যগুলো স্মরণ করে শেষ করি মার্কিন অভিনেতা উইল রজার্সের (১৮৭৯—১৯৩৫) একটি উক্তি দিয়ে।
রজার্স বলেছিলেন, সবকিছু বদলে যাচ্ছে। মানুষ কৌতুক অভিনেতাদের কথা গুরুত্বসহকারে নিচ্ছে। রাজনীতিবিদদের বক্তব্য গ্রহণ করছে কৌতুক হিসেবে।