মানুষের সম্ভাবনায় আস্থা রেখে পর্দা নামল হোপ ফেস্টিভ্যালের

হোপ ফেস্টিভ্যালে তাগা আউটস্ট্যান্ডিং ইয়াং প্রফেশনালস অ্যাওয়ার্ড ২০২৩ বিজয়ীদের সঙ্গে অতিথিরা। শনিবার রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে
ছবি: দীপু মালাকার

প্রকৃতি থেকে মাঘ বিদায় নেবে নেবে করছে। দুপুর থেকে রোদের তেজও এখন বাড়ছে। শনিবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে রোদের সেই তেজ যখন পড়তে শুরু করল, তখন রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে সিঁথি সরকার গাইছিলেন ‘যদি ঝড়-বাদলে আঁধার রাতে দুয়ার দেয় ঘরে/ তবে বজ্রানলে/ আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা জ্বলো রে/ যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।’ এ সময় দর্শক সারিতে থাকা শ্রোতারাও একাত্মতা প্রকাশ করেন, তাঁরা শিল্পীর সঙ্গে সুর মেলান।

এর মধ্য দিয়ে তিন দিনব্যাপী ব্র্যাকের হোপ ফেস্টিভ্যালের (আশা উৎসব) সমাপনী দিনের আয়োজন নতুন মাত্রা পায়। ৫০ বছর পূর্তি উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানের শেষ আয়োজন হিসেবে এ সংগীত আসরের আয়োজন করে ব্র্যাক।

হোপ ফেস্টিভ্যালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তরুণ প্রজন্মের পাঁচজনকে ‘আমরা নতুন ইয়াং চেঞ্জমেকারস অ্যাওয়ার্ড’ দেওয়া হয়। শনিবার রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে
ছবি: দীপু মালাকার

আসরে সিঁথি সরকারের পর একে একে গান করেন চন্দনা মজুমদার, মাশা ইসলাম ও সানজিদা মাহমুদ নন্দিতা। লালন ফকিরের ‘মানুষ ছাড়া খ্যাপা রে তুই মূল হারাবি’ গানটি গাইতে গিয়ে চন্দনা মজুমদার বলেন, ‘আমরা যদি মানুষকে ভজতে না পারি, মানুষ তো হতে পারব না।’ ততক্ষণে আর্মি স্টেডিয়াম মাঠ মানুষে পূর্ণ হতে শুরু করেছে। গানের এ আয়োজনে পাঁচটি একক গান ও দুটি যৌথ গান পরিবেশন করেন এই সংগীতশিল্পীরা।

তিন দিনব্যাপী হোপ ফেস্টিভ্যালের সমাপনী বক্তব্য দেন ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্। শনিবার রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে
ছবি: দীপু মালাকার

বিকেলের এ গানের আসরের মতো হোপ ফেস্টিভ্যালের শেষ দিনে ১২টি সেশন ছিল। দুপুর ১২টায় ব্র্যাক স্কুল, এডোলেসেন্ট ডেভেলপমেন্ট ক্লাব, ব্র্যাক কুমন ও একমাত্রার শিক্ষার্থীরা কবিতা, গান ও নৃত্য পরিবেশন করেন। এরপর জলবায়ু পরিবর্তন ও তার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর কৌশল বিষয়ে একটি আলোচনা অনুষ্ঠান হয়। সেখানে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ, ব্র্যাকের জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির পরিচালক লিয়াকত আলী প্রমুখ আলোচনায় অংশ নেন। তাঁরা মনে করেন, বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি মাথায় রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা ও উদ্যোগগুলো নিতে হবে।

হোপ ফেস্টিভ্যালের সমাপনী দিনে ছিল মনোমুগ্ধকর সংগীত পরিবেশনা। শনিবার রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে
ছবি: দীপু মালাকার

এরপর আরমিন মুসা ও খৈয়াম সানু সন্ধির পরিচালনায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশি-বিদেশি শিক্ষার্থীদের দল ‘ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস কয়্যার’ বিভিন্ন ভাষায় সংগীত পরিবেশন করে।

দেশের তরুণ ও উদ্যমী পেশাদার নারীদের স্বীকৃতি জানাতে আড়ংয়ের ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘তাগা’ প্রথমবারের মতো ‘তাগা আউটস্ট্যান্ডিং ইয়াং প্রফেশনালস অ্যাওয়ার্ড’ দেয়। মনোনয়নপ্রক্রিয়ায় দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সর্বোচ্চ ৫ জন করে ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সী অসাধারণ পেশাদার নারীর নাম চাওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে সেরা ৯ নারীকে দেওয়া হয় পুরস্কার। বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার দেওয়ার আগে ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তামারা হাসান আবেদ বলেন, ‘আজকে আমরা তাঁদেরই স্বীকৃতি দেব, যাঁরা পর্দার আড়ালে কাজ করেন এবং বড় ধরনের প্রভাব রেখে চলেছেন।’

হোপ ফেস্টিভ্যাল শেষ হয় জেমসের গানের মধ্য দিয়ে। শনিবার রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে
ছবি: দীপু মালাকার

উৎসবের শেষ দিনটিকে উৎসর্গ করা হয় দেশের তরুণ প্রজন্ম ও চেঞ্জমেকারদের প্রতি, যাঁরা নিজ নিজ প্রকল্পের মাধ্যমে মানুষের সেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তরুণ প্রজন্মের এমন পাঁচজনকে ‘আমরা নতুন ইয়াং চেঞ্জমেকারস অ্যাওয়ার্ড’ দেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য ওয়াশরুম নিশ্চিত করতে কাজ করায় এই বিভাগে প্রথম পুরস্কার পান নাঈম মোল্লা। তিনি বলেন, অনেক শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কিছু খান না ওয়াশরুমে যেতে হবে ভেবে। তাঁদের জন্য ওয়াশরুম নিশ্চিত করতে এ পুরস্কার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।

হোপ ফেস্টিভ্যালে গানে মাতোয়ারা দর্শক। শনিবার রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে
ছবি: দীপু মালাকার

এরপর ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক শামেরান আবেদ বলেন, ‘গত ৫০ বছরের অভিজ্ঞতায় আমাদের এই বিশ্বাস জন্মেছে যে অনেক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও অগ্রগতি সম্ভব, যদি আমরা মানুষের নিজস্ব ক্ষমতা ও সম্ভাবনার ওপর আস্থা রাখি।’ তাঁর বক্তব্যের পর কানায় কানায় পূর্ণ আর্মি স্টেডিয়ামের দর্শকেরা নেমেসিস ও আর্টসেল ব্যান্ডের গানে মেতে ওঠেন।

তিন দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানের সমাপনী বক্তব্য দেন ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্। তিনি বলেন, ‘দেশের যে মানুষদের সংগ্রাম, সাহস ও ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প আমরা বলি না, তাঁদের গল্পটা এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে সামনে আনার চেষ্টা করেছি।

যাতে তাঁদের গল্প শুনে অনুপ্রাণিত হই। সামনের দিনে সব সমস্যা মোকাবেলায় আশার আলো দেখি।’ এরপর নগরবাউল জেমসের গানের মধ্য দিয়ে শেষ হয় ব্র্যাকের আশা উৎসব।