বিবিএ-এমবিএ করে মাছের ব্যবসায়, এখন মাসে মুনাফা লাখো টাকা

নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে মাহফুজুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

উচ্চশিক্ষার জন্য ২০১১ সালে নীলফামারী থেকে ঢাকায় আসেন মাহফুজুল ইসলাম। ঢাকায় তিনি মেসে ওঠেন। মেসজীবনে দেখেন, বাজার থেকে মাছ কিনে আনলে গৃহপরিচারিকা বিরক্ত হন। কারণ, মাছ কাটা-ধোয়া তাঁর জন্য বেশ ঝামেলার কাজ। পরে মাহফুজুল বুঝতে পারেন, এ শহরের অন্যরাও একই সমস্যায় আছেন। ব্যবসার ধারণাটি তখনই তাঁর মাথায় আসে।

মাহফুজুল ভাবলেন, ঢাকার বাইরে থেকে তাজা মাছ সংগ্রহ করে কেটে-ধুয়ে একদম রান্নার উপযোগী করে যদি বাসায় বাসায় পৌঁছে দেওয়া যায়, তাহলে নগরবাসীর ঝামেলা কমবে। তাঁর আয়ও হবে। এ ভাবনা থেকে শিক্ষার্থী অবস্থাতেই স্বল্পপরিসরে ঢাকায় এ ব্যবসা শুরু করেন তিনি। বিবিএ-এমবিএ শেষ করে চাকরির পেছনে না ছুটে তিনি পুরোদমে এ ব্যবসায় নেমে পড়েন। এই তরুণ উদ্যোক্তার এখন মাসে মুনাফাই আসে লাখো টাকা।

মাহফুজুল ইসলামের প্রতিষ্ঠানের নাম ‘ফিশ মার্ট’
ছবি: সংগৃহীত

মাহফুজুলের (৩১) বাড়ি নীলফামারীর সৈয়দপুর। সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি-এইচএসসি শেষ করে তিনি ঢাকায় আসেন। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে অ্যাকাউন্টিংয়ে বিবিএ করেন তিনি। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি থেকে মার্কেটিংয়ে করেন এমবিএ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকাকালে ২০১৬ সালে ‘ফিশ মার্ট’ নামের অনলাইনভিত্তিক ব্যবসায়িক উদ্যোগ শুরু করেন বলে জানান মাহফুজুল। তিনি বলেন, ‘ভিড়বাট্টা ঠেলে বাজারে গিয়ে মাছ কেনা, ঘরে এনে কাটা-ধোয়া—নগরজীবনের এই ঝক্কি দেখে ব্যবসার ধারণাটি আমার মাথায় আসে। শিক্ষক মা-বাবার সন্তান আমি। মাছ সংগ্রহ-বিক্রির কিছুই আমি জানতাম না। বিষয়টি বোঝার জন্য প্রথমে আমি ঢাকার বাইরে যাই। যেখানে যেখানে ভালো-তাজা মাছ পাওয়া যায়, তা ঘুরে দেখি। ব্যবসা বোঝার চেষ্টা করি। হাতখরচ বাঁচিয়ে টাকা জমাই। ফেসবুকে পেজ খুলে শুরুতে আস্ত মাছ বিক্রি করি। পরে কেটে-ধুয়ে বিক্রি করি। মূলত তখনই আমার ব্যবসায় গতি আসে।’

কেটে-ধুয়ে রান্নার উপযোগী করে মাছ বাসায় পৌঁছে দেয় ‘ফিশ মার্ট’
ছবি: সংগৃহীত

চাহিদা বাড়ায় ২০১৭ সালে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে এক কক্ষের একটি অফিস নেন মাহফুজুল। করোনা মহামারি তাঁর জন্য ‘সাপে বর’ হয়ে আসে। তিনি বলেন, ‘দেশে করোনা হানা দিলে লকডাউন দেওয়া হয়। সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। তখন আমার কাছ থেকে মাছ নেওয়ার জন্য ফেসবুক পেজে অনেক অর্ডার আসতে থাকে। আমার আয় বেড়ে যায়।’

ব্যবসাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ২০২১ সালে ‘ট্রেড লাইসেন্স’ নেন মাহফুজুল। রাজধানীর আদাবর এলাকায় চার কক্ষের একটি ফ্লোর ভাড়া নেন তিনি। পূর্ণ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের আদলে তিনি অফিস সাজান। মাছ কাটার জন্য দেশের বাইরে থেকে যন্ত্র কিনে আনেন। কর্মী নিয়োগ দেন। এই অফিস আনুষ্ঠানিকভাবে চালুর সময় তিনি তাঁর মা- বাবাকে ব্যবসার কথা জানান। তাঁরা বিষয়টি ভালোভাবেই নেন।

তবে ব্যবসার শুরুর দিকে বন্ধুবান্ধব কিছুটা নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে ছিলেন বলে জানান মাহফুজুল। তাঁর ভাষ্যে, ‘বন্ধুরা বলাবলি করছিল, পড়ালেখা করে মাছের ব্যবসা কেন!’

মৈনটঘাট, চাঁদপুর, ভৈরব, বরিশালসহ বিভিন্ন স্থান থেকে তাজা মাছ সংগ্রহ করেন মাহফুজুল
ছবি: সংগৃহীত

মাহফুজুলের প্রতিষ্ঠানে এখন সব মিলিয়ে ২৭ কর্মী আছেন। ঢাকার অদূরের মৈনটঘাট, চাঁদপুর, ভৈরব, বরিশালসহ বিভিন্ন স্থান থেকে তাজা মাছ সংগ্রহ করেন তিনি। এই মাছ কেটে-ধুয়ে পুরোপুরি রান্নার উপযোগী করে তা ক্রেতাদের ঘরে পৌঁছে দেন তাঁর কর্মীরা। মাছের পাশাপাশি মাংসও বিক্রি করেন মাহফুজুল। ফেসবুক পেজ ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ক্রয়াদেশ গ্রহণ করে তাঁর প্রতিষ্ঠান।

মাছের মানের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন বলে জানান মাহফুজুল। একই সঙ্গে তাঁর প্রতিষ্ঠান দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাজা মাছ ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ বলে জানান তিনি।

মাহফুজুল বলেন, ‘এখন দিনে কম করে হলেও ৮০ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করি। সব খরচ বাদ দিয়ে মাসে দেড় লাখ টাকা মুনাফা হয়। চাকরি করলে মাসে এ টাকা আয় করা সম্ভব হতো না। চাকরির পেছনে না ছুটে ব্যবসা করে ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছি বলে মনে করি।’

ছয় থেকে সাত মাস ধরে ঢাকার বাইরে কিছু এলাকায় মাছ সরবরাহ করছেন মাহফুজুল। দেশের সব কটি বিভাগীয় শহরে প্রতিষ্ঠানের শাখা খোলার পরিকল্পনা আছে তাঁর। এক সন্তানের বাবা মাহফুজুল বলেন, তাঁর ব্যবসায় স্ত্রী তাসফিয়া ইসলাম সব ধরনের সহযোগিতা ও সমর্থন দিয়ে আসছেন। বন্ধুত্ব থেকে তাসফিয়াকে বিয়ে করেন তিনি। তাসফিয়া আপত্তি করলে তাঁকে হয়তো আজ চাকরিই করতে হতো, সফল উদ্যোক্তা হওয়া আর হতো না।