বুয়েটে র‍্যাগিং-বুলিং, দখল-বাণিজ্য, হত্যা-সন্ত্রাসের ছাত্ররাজনীতি হবে না: ছাত্রলীগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনে ছাত্রলীগের জরুরি সংবাদ সম্মেলনছবি: প্রথম আলো

ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, হাইকোর্টের আদেশের পর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্ররাজনীতি আবার শুরু হবে। কিন্তু সেটি কোন ছাত্ররাজনীতি, তা নিয়ে ভাবতে হবে। এই ছাত্ররাজনীতি অবশ্যই ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ, সেশনজট, র‍্যাগিং-বুলিং, দখল-বাণিজ্য ও হত্যা-সন্ত্রাসের ছাত্ররাজনীতি নয়। এই ছাত্ররাজনীতি হবে আধুনিক, যুগোপযোগী, বৈচিত্র্যময়, সৃষ্টিশীল, জ্ঞান-যুক্তি-তথ্য-তত্ত্বনির্ভর।

আজ মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এসব কথা বলা হয়। ‘বুয়েটে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব-উপযোগী আধুনিক, স্মার্ট ও পলিসিনির্ভর নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং উদ্ভূত পরিস্থিতির ওপর আলোকপাতের উদ্দেশ্যে’ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ এই সংবাদ সম্মেলন করে।

ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সাড়ে চার বছর আগে বুয়েট কর্তৃপক্ষের জারি করা ‘জরুরি বিজ্ঞপ্তি’র কার্যক্রম গতকাল সোমবার স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। এ-সংক্রান্ত এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল রুলসহ এ আদেশ দেন।

শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার পর ২০১৯ সালের ১১ অক্টোবর ওই ‘জরুরি বিজ্ঞপ্তি’ জারি করেছিল বুয়েট কর্তৃপক্ষ। এর বৈধতা নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ হোসেন গতকাল রিটটি করেন। ইমতিয়াজ বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের ছাত্র। তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।

আবরার ফাহাদকে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে হলের ভেতরে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় করা মামলায় আদালত ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী।

আজকের সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। ২০১৯ সালে বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর ছাত্রলীগ তার নৈতিক ও সাংগঠনিক অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে বলে দাবি করে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আবরারের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো হয়েছে। কিন্তু এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসন বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার যে সিদ্ধান্ত নেয়, তা ছাত্রলীগ অতীতেও সমর্থন করেনি, বর্তমানেও করে না। ছাত্রলীগ বারবার বলার চেষ্টা করেছে, বাংলাদেশের মহান সংবিধান ও বুয়েটের আইন কোনোটিই ছাত্ররাজনীতি বন্ধের এই সিদ্ধান্তকে বৈধতা দেয় না।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের পর পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ সময়ে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের নামে সেখানে ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ তাদের নিরাপদ আস্তানা হিসেবে খুঁটি গেড়ে বসেছে। বাঙালির মহান স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। জাতির পিতাকে স্মরণ করতে বাধা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে একজন শিক্ষার্থীর সংবিধানসম্মত চলাফেরা, মতপ্রকাশ, সমাবেশ ও সংগঠন করার অধিকারকে চূড়ান্তভাবে খর্ব করা হয়েছে। বৈষম্যমূলক, হিংসাত্মক ও বিভেদের সামাজিক পরিকাঠামো চালু করা হয়েছে। জোর করে মতবাদ চাপিয়ে দিয়ে শিক্ষার্থীদের সৃষ্টিশীল সত্তাকে হত্যা করার প্লট রচনা করা হয়েছে। মহান স্বাধীনতাসংগ্রামে অগ্রগামী ভূমিকা রাখা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন কর্মকাণ্ড কোনোমতেই মেনে নেওয়ার মতো নয়।

লিখিত বক্তব্যে সাদ্দাম হোসেন বলেন, তুচ্ছ কারণে, অপ্রাসঙ্গিকভাবে, জোর করে, স্বৈরাচারী কায়দায় গত ২৯ মার্চ বুয়েট শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ হোসেনের আবাসিক হলের আসন বাতিল করা হয়। তাঁকে বুয়েট থেকে স্থায়ী বহিষ্কারের দাবি উত্থাপন করা হয়। এটা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আড়ালে পরিচয় গোপন করে রাখা নিষিদ্ধ ও আন্ডারগ্রাউন্ড সংগঠনের কর্মীদের অহেতুক দাবি।

সাদ্দাম হোসেন বলেন, বুয়েট প্রশাসন অবিবেচকের মতো এই দাবি মেনে নিলে প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে দেশের ছাত্রসমাজ ও রাজনীতিসচেতন গণতন্ত্রকামী মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগ বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের অবৈধ আদেশ হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করলে আদালত তা বাতিল করে দেন। ফলে বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি পরিচালনা করতে আর কোনো বাধা নেই। ছাত্রলীগ বুয়েটের শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানাচ্ছে। দেশের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে এটি একটি ঐতিহাসিক দিন। বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি পুনরায় শুরু হবে।

সাদ্দাম হোসেন আরও বলেন, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে, বিশ্বের সর্বোচ্চ র‍্যাঙ্কিংধারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতি কীভাবে পরিচালনা হয়, তা থেকে জ্ঞান নিয়ে, নিজেদের চর্চায় সেটি নিয়ে বুয়েট ছাত্ররাজনীতিকে পথ নির্দেশ করবে।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, প্রথাগত ছাত্ররাজনীতিতে কেন্দ্র থেকে চাপিয়ে দেওয়া নেতৃত্বের মাধ্যমে বুয়েট শিক্ষার্থীরা পরিচালিত হবেন না। বুয়েটের শিক্ষার্থীরা নিজেরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁদের নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন। এই নেতৃত্ব হবে আদর্শিক ও দেশাত্মবোধসম্পন্ন। এই নেতৃত্ব বুয়েটের শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকেই তৈরি করবে বিশ্বসেরা উদ্ভাবক ও উদ্যোক্তা। বুয়েটে আগামী দিনে এমন ছাত্ররাজনীতি পরিচালিত হবে, যা প্রতিবছর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বুয়েট শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার নামে ‘ব্রেন ড্রেইন’ বন্ধ করবে। বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি ফিরিয়ে এনে কেবল ছাত্রলীগ তার দায়িত্ব শেষ করবে না; শেখ হাসিনার পরিকল্পিত আগামী দিনের উন্নত, স্মার্ট বাংলাদেশে উন্নত ও স্মার্ট ছাত্ররাজনীতি উপহার দেওয়ার জন্য মডেল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ছাত্রলীগ বুয়েটকে গ্রহণ করবে। এই ঐতিহাসিক যাত্রায় বুয়েটের সব শিক্ষার্থীকে সহযোগিতার সংকল্প নিয়ে পাশে থাকার আহ্বান জানাচ্ছে ছাত্রলীগ।

বুয়েটে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব-উপযোগী আধুনিক, স্মার্ট ও পলিসিনির্ভর নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চার দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন সাদ্দাম হোসেন। এগুলো হলো, ইমতিয়াজ হোসেনের আবাসিক হল ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে বুয়েট শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি; আধুনিক, স্মার্ট ও পলিসিনির্ভর নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি প্রতিষ্ঠার কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণে বুয়েট শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতামত আহ্বান ও আলোচনা; সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী-জঙ্গি কালোছায়া থেকে বুয়েটকে মুক্ত করতে সেমিনার ও সাংস্কৃতিক উৎসব আয়োজন; বুয়েটে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা।

এক প্রশ্নের জবাবে সাদ্দাম হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবের মাধ্যমে বুয়েটে ছাত্রলীগের কমিটি হবে।

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন ও সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি রাজিবুল ইসলাম, মহানগর উত্তরের সভাপতি রিয়াজ মাহমুদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।