আড়াই বছর গুলশানের পার্কে যেতে পারছে না এলাকাবাসী

শহীদ ডা. ফজলে রাব্বী পার্কের সীমানার কাচের দেয়াল
ছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর গুলশান-১ নম্বর এলাকার শহীদ ডা. ফজলে রাব্বী পার্কটির সংস্কারকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ৯ মাসে। দফায় দফায় সময় বাড়িয়ে সেই ৯ মাস গিয়ে ঠেকেছে আড়াই বছরে। তবু পার্কের সংস্কারকাজ শেষ হয়নি।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বলছে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কাছ থেকে সঠিক সময়ে নকশা না পাওয়ায় কাজ পিছিয়েছে। তবে বুয়েট এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছে। সিটি করপোরেশন দেরির জন্য বুয়েট ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দুজনকেই দায়ী করেছে।

পার্কটি সংস্কারে মোট ১১ কোটি ৫২ লাখ ৭২ হাজার টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তারা। কাজটি করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এম আর কনস্ট্রাকশন।

কাজে দেরির যত কারণ

পার্ক সংস্কারের কার্যাদেশ ২০২০ সালের জুলাইয়ে দেওয়া হয়েছিল। শেষ হওয়ার কথা ছিল পরের বছর এপ্রিলে, অর্থাৎ ৯ মাসে। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় আরও ছয় মাস (অক্টোবর) মেয়াদ বাড়ানো হয়। এরপরও সংস্কারকাজের অগ্রগতি ছিল মাত্র ৫০ শতাংশ।

পরে দফায় দফায় আরও কয়েকবার মেয়াদ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ মেয়াদ ছিল গত ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত। ওই সময়েও ঠিকাদার কাজ শেষ করতে পারেননি। ফেব্রুয়ারির হিসাবে কেটে গেছে মোট ৩০ মাস। তবুও শেষ হয়নি সংস্কারকাজ।

সংস্কারকাজ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শেষ হবে দাবি করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, বুয়েটের কাছ থেকে সঠিক সময়ে নকশা পাওয়া যায়নি। এ জন্য পিছিয়ে যেতে হয়েছে।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ, পার্কের পানিনিষ্কাশনের নালা বুয়েট আঁকাবাঁকা করে নকশা করেছিল। নকশা অনুযায়ী নালা নির্মাণে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এ ছাড়া পার্কের সীমানার কাচের দেয়াল নিয়েও জটিলতা ছিল। বুয়েটের দেওয়া নকশা অনুযায়ী সীমানার অনেক বড় গাছ কেটে ফেলা লাগত। সেই নকশা পাল্টে দেয়ালটি কিছুটা আঁকাবাঁকা করে বানানো হয়েছে।  

শহীদ ডা. ফজলে রাব্বী পার্কের কাজ শেষ হয়নি আড়াই বছরেও
ছবি: প্রথম আলো

পার্কের পাশে থাকা ঢাকা ওয়াসার পানির গভীর নলকূপ সরানোর কথা থাকলেও তা হয়নি। ফলে ওই অংশেও কাজ শুরু করতে দেরি হয়েছে বলে জানান ঠিকাদারের প্রতিনিধি। আর বুয়েটের পরামর্শকেরা এখনো পার্কের পূর্ব পাশে একটি ফটক নির্মাণ নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারছেন না বলেও জানান তিনি।

এ বিষয়ে মোহাম্মদ হাসানের ভাষ্য, ‘কাজ প্রায় শেষের দিকে। অথচ একটা গেট নিয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিচ্ছে না। একবার বলছে পুরোপুরি বন্ধ করতে। আবার বলছে ছোট একটি ফটক রাখতে।’

এ ব্যাপারে বুয়েট পরামর্শক দলের প্রধান অধ্যাপক নাজমুল ইমাম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এ বিষয়ে তিনি সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
নকশা পরিবর্তনের কারণেই পার্ক সংস্কারে দেরি বলেছেন ঢাকা উত্তর সিটির পরিবেশ ও জলবায়ু সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) নুরুজ্জামান খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বুয়েট থেকে নকশা পেতে কিছুটা দেরি হয়েছে। ঠিকাদারদেরও কিছু গাফিলতি আছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় ঠিকাদারও ধীরগতিতে কাজ করছেন।

সার্বিক অগ্রগতি ৯০-৯৫ ভাগ হয়েছে মন্তব্য করে নুরুজ্জামান খান আরও বলেন, ‘নকশার বিভিন্ন অংশ ভাগ করে দেওয়া হয়। আমরা এখনো পূর্ব দিকের ছোট একটা ফটকের নকশা পাইনি। অথচ এ নিয়ে গত অক্টোবর থেকে বুয়েটের প্রতিনিধি দলের আলোচনা-যোগাযোগ করেছি। এই মাসের মধ্যে সংস্কারকাজ শেষ হবে বলেন তিনি।’

এলাকাবাসী বিরক্ত

সংস্কারের কারণে দীর্ঘদিন পার্কটি বন্ধ থাকায় বিরক্ত গুলশান ও নিকেতন এলাকার বাসিন্দারা। কেউ কেউ বলছেন, পার্কে তেমন কিছুই সংস্কার করার প্রয়োজন ছিল না। শুধু হাঁটার রাস্তা (ওয়াকওয়ে) করে দিলেই হতো। আর শৌচাগার সংস্কারের প্রয়োজন ছিল। সেখানে বাড়তি অনেক কিছু করার নামে পার্কের ক্ষতি করা হচ্ছে।

গুলশান-১ নম্বরের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সময় থেকে পার্কটি সংস্কারের নামে বন্ধ রাখা হয়েছে। টিনের বেড়া থাকায় ভেতরে কী হচ্ছে, কতটুকু কাজ হচ্ছে, তা বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। আরও কত দিন লাগে, সেটা সিটি করপোরেশনই জানে।

একসময় পার্কে প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে হাঁটতেন নিকেতনের বাসিন্দা রোকসানা কবির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সকালে পার্কে আসলেই মনটা ভালো হয়ে যেত। দুই বছর হয় পার্কে আসতে পারি না। এখন লেকের পার দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করি।’ তিনি পার্কটি দ্রুত খুলে দেওয়ার দাবি জানান।

সরেজমিনে দেখা যায়, পার্কের চারপাশটা টিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা। এরপরই স্বচ্ছ কাচ দিয়ে সীমানা দেয়াল করা হচ্ছে। বিদেশ থেকে আনা কাচের অংশগুলো লোহার কাঠামোতে স্থাপন করছেন কর্মীরা। পার্কটির পূর্ব-দক্ষিণ কোনায় সার্ভিস ব্লকের কাজ শেষ। ব্লকটির ছাদ থেকে সামনের দিকে মাটি দিয়ে ঢালু করে কৃত্রিম টিলা তৈরি করা হয়েছে।

পশ্চিম পাশে মাটি খুঁড়ে জলাধারের মতো করা হয়েছে। তাতে নির্দিষ্ট দূরত্বে বসেছে সিমেন্টের পিলার। জলাশয়ে প্রাকৃতিকভাবে পানি জমা রাখা হবে। ওপর দিয়ে তৈরি হবে স্টিলের একটি সাঁকো তৈরির কাজ চলছে। তবে হাঁটার পথের ওপরের ছাউনি বসানো কাজ শুরু হয়নি।

ঢাকা উত্তর সিটির প্রকৌশলীরা বলছেন, চারপাশে ১৫ ফুটের কাচের দেয়াল থাকবে, যা রাস্তার যানবাহন থেকে সৃষ্ট উচ্চ শব্দ পার্কে যাওয়া রোধ করবে। কাচের দেয়াল যেহেতু উঁচু হবে, তাই পাখির চলাচলে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, এ কারণে কাচে সমান্তরাল অস্বচ্ছ রেখা বা বার্ড স্ট্রিপ থাকা কাচ বসানো হচ্ছে।