সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণ : ‘ওর শরীরের কিচ্ছু আর নাই, সব পুড়েছে’

স্নাতকের শিক্ষার্থী মো. জাহান সরদার কলেজ থেকে বাসায় ফেরার পথে বিস্ফোরণে আহত হয়ে আইসিইউতে ভর্তি
ছবি: সংগৃহীত

সরকারি দোহার নবাবগঞ্জ কলেজের স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী মো. জাহান সরদার (২০) গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরছিলেন। যানজট দেখে বাস থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করেন তিনি। তবে বাসায় আর ফেরা হয়নি।

রাজধানীর গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে কুইন স্যানিটারি মার্কেট হিসেবে পরিচিত ভবনের সামনে দিয়ে হেঁটে ফেরার সময় হঠাৎই বিস্ফোরণ ঘটে। এতে গুরুতর দগ্ধ হন জাহান। এখন শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি আছেন তিনি।

আইসিইউর সামনে অপেক্ষারত জাহানের বাবা জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে আজ বুধবার কথা হয়। ছেলে কেমন আছে, জিজ্ঞেস করতেই তাঁর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আশা এখন ওপরওয়ালার হাতে, আমার একটাই ছেলে, তিনি যদি ফিরায়ে দেন।’

জাহাঙ্গীর আলমের বাসা যাত্রাবাড়ীতে। তিনি সেখানে সবজির ব্যবসা করেন। তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে। জাহান ছোট। জাহাঙ্গীর বলেন, ‘জ্যাম দেখে ও (জাহান) বাস থেকে নেমে হাঁটতে থাকে। সিদ্দিকবাজারের ওই ভবনের সামনে আসার পরই নাকি এমন (বিস্ফোরণ) হয়।’

ছেলের এক বন্ধুর মাধ্যমে এই বাবা জানতে পারেন, জাহান আহত হয়ে হাসপাতালে আছে। জাহানের শুধু পায়ের গোড়ালি দুটোই অক্ষত আছে উল্লেখ করে বাবা বলেন, ‘ওর শরীরের কিচ্ছু আর নাই, সব পুড়েছে।’

বিস্ফোরণে আহত ভ্যানচালক খলিল শিকদারের মেয়ে, স্ত্রী ও ছেলে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে এসেছেন।
ছবি: প্রথম আলো

গতকাল বিকেলে কুইন স্যানিটারি মার্কেটের সামনে খ্যাপের (ভাড়ার অপেক্ষা) আশায় ছিলেন খলিল শিকদার (৫৫) ও অলিল শিকদার (৬০) নামের দুজন ভ্যানচালক। সম্পর্কে তাঁরা দুই ভাই। বাড়ি মাদারীপুরে। বিস্ফোরণে দুই ভাইয়ের শরীরের অনেকটা পুড়ে গেছে। বিশেষ করে বড় ভাই অলিলের অবস্থা বেশি গুরুতর। চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, পুরো শরীর পুড়েছে।  

খবর পেয়ে খলিলের স্ত্রী কোহিনুর বেগম সন্তানদের নিয়ে মাদারীপুর থেকে বার্ন ইনস্টিটিউটে এসেছেন। স্বামীর আয়েই সংসার চলে। তিন মেয়ে ও দুই ছেলে তাঁদের। দুই মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। বাড়িতে এক মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে থাকেন কোহিনুর। বড় ছেলে ঢাকায় একটি দোকানে কাজ করেন। স্বামীর চিকিৎসা, সংসার—সব মিলিয়ে কোহিনুরের দিশাহারা অবস্থা।  

বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ইয়াসিন আরাফাতের (২৬) জন্য কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে গেছে মা ঝর্ণা বেগমের। ছেলে ইয়াসিন একটি স্যানিটারি পণ্যের দোকানের কর্মী। দোকানটি ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের নিচতলায় ছিল। বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হন ইয়াসিন।

ইয়াসিনের খবর শুনে নোয়াখালী থেকে ছুটে এসেছেন মা ঝর্ণা। আইসিইউর বাইরে আহাজারি করছিলেন তিনি। তাঁর চার ছেলেমেয়ের মধ্যে ইয়াসিন সেজ। সংসারে সচ্ছলতা আনতে কয়েক বছর আগে ঢাকায় আসেন তিনি।

সিদ্দিকবাজারে ফুটপাতে স্কুলব্যাগ বিক্রি করতেন মো. হাসান। বিস্ফোরণে তাঁর দোকান উড়ে গেছে। তিনি গুরুতর আহত হয়ে আইসিইউতে আছেন।
ছবি: সংগৃহীত
আরও পড়ুন

বিস্ফোরণের ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে আইসিইউতে আছেন মো. হাসান (৩২)। তাঁর শ্যালক মো. জামাল উদ্দিন জানান, তাঁদের বাড়ি নোয়াখালী। দুই বছর আগে ঢাকায় এসে সিদ্দিকবাজারে ফুটপাতে স্কুলব্যাগ বিক্রি শুরু করেন হাসান। কুইন স্যানিটারি মার্কেটের সামনেই তিনি বসতেন। পাশেই ছিল জামাল উদ্দিনের পর্দার দোকান।

জামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসরের নামাজের জন্য মসজিদে যাওয়ার সময় দুলাভাইকে দোকানের প্রতি খেয়াল রাখতে বলে গিয়েছিলাম। নামাজ প্রায় শেষ। এ সময় হঠাৎ আওয়াজ পাই। মসজিদও কেঁপে ওঠে। ভাবছি ট্রান্সফরমারের কিছু হইছে। পরে মসজিদের জানালা দিয়ে দেখি আগুন। বের হয়ে দেখি মানুষ ছোটাছুটি করছে। আমাদের দুজনের দোকানই উড়ে গেছে।’

আরও পড়ুন

বিস্ফোরণের পর খোঁজ করতে করতে রাত ১০টার দিকে বার্ন ইনস্টিটিউটে ভগ্নিপতি হাসানকে খুঁজে পান জামাল। বলেন, হাসানের তিন ছেলেমেয়ে। একজনের বয়স সাত বছর, একজনের চার ও অন্যজনের দুই বছর।

হাসান নিজের সংসার ছাড়াও বাবা-মাকে দেখাশোনা করতেন। তাঁরা সবাই নোয়াখালীতে থাকেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির এ অবস্থা জামালকে ভাবিয়ে তুলছে। পরিবারের কাউকে এখনো কিছু জানাননি জামাল। বলেন, ‘ওরা এমনিতেই অনেক টেনশনে আছে। আর টেনশন দিতে চাই না।’