তরুণ শিল্পীদের আঁকা পোস্টারে উঠে এল মুক্তিযুদ্ধের চিত্র

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সপ্তাহব্যাপী আন্তবিশ্ববিদ্যালয় পোস্টার প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনী উদ্বোধনের পর ঘুরে দেখেন অতিথিরা। ঢাকা, ১২ সেপ্টেম্বর
ছবি: দীপু মালাকার

পোস্টারে শিল্পের ভাষায় প্রতিবাদ করা যায়। দেশের সব আন্দোলন–সংগ্রামে স্লোগান আর ছবির মেলবন্ধনে শিল্পীদের আঁকা পোস্টারগুলো গণজাগরণ সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। তার রেশ ধরেই মহান মুক্তিযুদ্ধে নতুন প্রজন্মের সৃজনশীলতার স্পর্শে নান্দনিক রূপে উঠে এল হাতে আঁকা পোস্টার।

আজ মঙ্গলবার থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সপ্তাহব্যাপী আন্তবিশ্ববিদ্যালয় পোস্টার প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনী। সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভবনের নিচতলায় প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন বরেণ্য শিল্পী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুন নবী।

বিশ্ববিদ্যালয় মিলনায়তনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বক্তব্যে শিল্পী রফিকুন নবী বলেন, গত শতকের পঞ্চাশ–ষাটের দশকে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক, জগন্নাথ কলেজ—এই এলাকা ছিল ঢাকার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম কেন্দ্র। শিল্পীরা সব আন্দোলনে অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছেন। সে সময় রাত জেগে শিল্পীরা যেসব পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন আঁকতেন; সেগুলোই মিছিলে, দেয়ালে–দেয়ালে শোভা পেত। বিশেষ করে রাজনৈতিক পোস্টারগুলো আন্দোলন–সংগ্রামে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, ‘সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পোস্টারের রূপের পরিবর্তন হয়েছে। এখন হাতে লেখা পোস্টারের পরিবর্তে এসেছে ডিজিটাল পোস্টার। তবে হাতে লেখা পোস্টার একটা সময় আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বেগবান করতে এবং জনসাধারণকে আন্দোলনে অংশ নিতে অনুপ্রাণিত করেছে।’

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘সৃজনশীল মানুষের দায়: ইতিহাসের ক্রান্তিকাল’ শীর্ষক মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন শিল্পত্বাত্তিক অধ্যাপক আবুল মনসুর। তিনি সমাজ বিবর্তন ও শিল্পকলার ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘ আলোচনায় বলেন, চারুকলা হোক বা সাহিত্য, সংগীত শিল্পসংস্কৃতি সব ক্ষেত্রেই সৃজনশীল মানুষেরা সমাজের ক্রান্তিকালে নিজেদের দায়বদ্ধতার বিষয়টি উপলব্ধি করেছেন। নিজেদের মতো করে প্রতিবাদ–প্রতিরোধ করেছেন। উত্তরণের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। আমাদের দেশেও সৃজনশীল মানুষেরা এই দায়িত্ব থেকে তাদের ভূমিকা পালন করেছেন। দৃশ্যশিল্পের ক্ষেত্রে দেখা যাবে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মন্বন্তরের ছবি এঁকেছেন। মুর্তজা বশীর ভাষা আন্দোলনের সময় যে ছাপচিত্রগুলো করেছেন, তা সে সময় আন্দোলন এগিয়ে নিতে ভূমিকার রেখেছে। আবার মুক্তিযুদ্ধের সময় কামরুল হাসানের আঁকা ইয়াহিয়া খানের মুখাকৃতি নিয়ে পোস্টারসহ অন্য শিল্পীদের আঁকা পোস্টারগুলো ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। শিল্পীরা এভাবে তাঁদের ভূমিকা রেখেছেন।

পোস্টারের বৈশিষ্ট্য এবং এর নান্দনিকতা নিয়ে আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেন বলেন, পোস্টারের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এর মূল বক্তব্যের গুণমান, দ্বিতীয়ত, অক্ষরগুলোর বৈশিষ্ট্য এবং তৃতীয়ত, বিষয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে ছবির সংযোগ করা। তিনি শিক্ষার্থীদের এই বিষয়গুলোর প্রতি সচেতন থাকতে পরামর্শ দেন।

বরেণ্য শিল্পী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুন নবী আন্তবিশ্ববিদ্যালয় পোস্টার প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন । ঢাকা, ১২ সেপ্টেম্বর
ছবী: দীপু মালাকার

শিল্পসমালোচক মঈনুদ্দিন খালেদ পোস্টারের শিল্পমান নিয়ে আলোচনা করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রুশ বিপ্লবের পরে রাশিয়া এবং পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরিতে বহু অসাধারণ পোস্টার তৈরি করা হয়েছিল।

আলোচনায় আরও অংশ নেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের সভাপতি ফারহানা তাবাসসুম, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক এ এইচ এম আখতারুল ইসলাম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আলপ্তগীন, বিচারকমণ্ডলীর সদস্য শিল্পী আবদুল মানান। সভাপতিত্ব করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক কামালউদ্দিন আহমেদ। সঞ্চালনা করেন অধ্যাপক শিল্পী রশীদ আমিন।

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এই আন্তবিশ্ববিদ্যালয় পোস্টার প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনীর আয়োজন করে। তবে ডিসেম্বর মাসে পরীক্ষাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানিক কাজের ব্যস্ততা থাকায় প্রদর্শনী বিলম্ব হলো বলে আয়োজকেরা উল্লেখ করেন। প্রতিযোগিতায় স্বাগতিক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ ও নারায়ণগঞ্জ চারুকলা ইনস্টিটিউটের ৭৭ শিক্ষার্থী অংশ নেন।

আন্তবিশ্ববিদ্যালয় পোস্টার প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনী ঘুরে দেখেন দর্শনার্থীরা। ঢাকা, ১২ সেপ্টেম্বর
ছবি: দীপু মালাকার

প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদিশা অধিকারী, দ্বিতীয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদিয়া নিশাত এবং তৃতীয় হয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জান্নাতুল সায়মা। শিক্ষার্থীদের আঁকা পোস্টারে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা ও নারী নির্যাতন, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ সংগ্রাম এবং এক নদী রক্তের বিনিময়ে অর্জিত চূড়ান্ত বিজয়ের নানা ঘটনা উঠে এসেছে। ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রদর্শনী সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।