আবুল মনসুর আহমদ: ইতিহাসের বাঁকবদলগুলোর কেবল প্রত্যক্ষদর্শী নন, নিজেও রেখেছেন তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা

আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে আলোচনা এবং প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণীর অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ঢাকা, ১৬ সেপ্টেম্বর
ছবি : তানভীর আহাম্মেদ

আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন একজন বহুমাত্রিক ব্যক্তি। বর্ণাঢ্য তাঁর জীবন–অভিজ্ঞতা। প্রত্যক্ষ করেছেন ঔপনিবেশিক কালের শেষ পর্যায়। সেখান থেকে দেশভাগের মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিকতার অবসান এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। ইতিহাসের এই বাঁকবদলগুলোর কেবল প্রত্যক্ষদর্শী নন, তিনি নিজেও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের মুজাফফর আহমদ চৌধুরী মিলনায়তনে শনিবার বিকেলে এক আয়োজনে বক্তারা আবুল মনসুর আহমদ সম্পর্কে এমন মন্তব্য করেন। তাঁদের বক্তব্যে উঠে আসে সাংবাদিকতা থেকে আইন পেশা ও সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালন পর্যন্ত আবুল মনসুর আহমদের গুণ ও কর্ম বৈভবময়। তিনি ভাষার রাজনৈতিক গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন ভারতভাগের বহুকাল আগেই। বিশ্বাস করতেন ভাষা, কৃষ্টি, সাহিত্য, রাজনীতি নিয়ে এ দেশের মানুষের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। চেয়েছিলেন তারা এই বৈশিষ্ট্য নিয়েই পরিচিতি লাভ করুক। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই তিনি সাংবাদিকতা, সাহিত্যকর্ম ও রাজনীতি করেছেন।

আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে আলোচনা এবং এ উপলক্ষে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণীর এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পরিষদ আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন দ্য নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবীর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলী আর রাজী, সমকাল–এর পরিকল্পনা সম্পাদক ফারুক ওয়াসিফ। আবুল মনসুর আহমদের জীবন ও সাংবাদিকতা নিয়ে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন সাংবাদিক ও গবেষক কাজল রশীদ। সঞ্চালনা করেন স্মৃতি পরিষদের আহ্বায়ক ইমরান মাহফুজ। আবুল মনসুর আহমদের ছেলে দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম অসুস্থতার কারণে সরাসরি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে না পারলেও শুরুতেই ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে অনুপস্থিতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং আয়োজকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে আলোচনা এবং প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণীর অনুষ্ঠানে অতিথিদের সঙ্গে বিজয়ীরা । ঢাকা, ১৬ সেপ্টেম্বর
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

মূল আলোচনায় আবুল মনসুর আহমদের জীবনী তুলে ধরা হয়। তাঁর জন্ম ১৮৯৭ সালে। কলকাতায় ‘ছোলতান’ পত্রিকায় সহসম্পাদক পদে যোগ দিয়ে তিনি পেশাগতভাবে সাংবাদিকতা শুরু করেন ১৯২৩ সালে। প্রায় ২৫ বছর তিনি সাংবাদিকতা করেছেন। কাজ করেছেন দ্য মুসলমান, খাদেম, মোহাম্মদী পত্রিকায়। এ ছাড়া সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন দৈনিক কৃষক, নবযুগ ও ইত্তেহাদ পত্রিকায়। নেতৃত্ব ও প্রতিভায় তিনি সংবাদপত্রকে শিল্প হিসেবে দাঁড়াতে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর হাত ধরেই পরবর্তীকালে বহু কৃতী সাংবাদিক সংবাদপত্রের জগতে এসেছেন।

আলোচনায় অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘রাষ্ট্রব্যবস্থাপনায় সমাজে সাংবাদিকতার গুরুত্ব কত, তা আবুল মনসুর আহমদ মর্মে মর্মে অনুভব করেছিলেন। এখনো আমরা দেখছি মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে নানা রকমভাবে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো অনেক রকমের আইন করা হচ্ছে। এগুলো রাজনীতির বিষয়। এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হলে সাংবাদিকতার মাধ্যমেই জনমত তৈরি করতে হবে। আবুল মনসুর আহমদ এই বিষয়টি উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকেই সাংবাদিকতা করেছেন।’

নূরুল কবীর বলেন, আবুল মনসুর আহমদ স্রোতে গা ভাসাননি। তিনি যুক্তিবাদী মানুষ ছিলেন। কারও দিকে তাকিয়ে কথা বলেননি। যুক্তি ও বিবেচনায় যা সঠিক বলে মনে করেছেন, তা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন। তিনি বিবেচনা করতেন জনপ্রিয় মতামত সব সময় সঠিক নয় এবং এ কারণে জনস্রোত থেকে ভিন্নমত প্রকাশের সাহস দেখিয়েছেন। তার জন্য ব্যক্তিগত লাভ–ক্ষতির বিবেচনা করেননি।

আলী আর রাজী বলেন, আবুল মনসুর আহমদ পূর্ব বাংলার মানুষের মুখের ভাষাকে কেন্দ্র করে প্রমিত বাংলা ভাষা গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। এর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন। তিনি চেয়েছেন মানুষের মুখ থেকে ভাষা কলমে আসুক, কলম থেকে মুখে নয়।

ফারুক ওয়াসিফও তাঁর বক্তব্যে বাংলা ভাষা ও কৃষ্টির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আবুল মনসুর আহমদের ভাবনা ও চেষ্টার দিকটি তুলে ধরেন।

আলোচনা শেষে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।