বৃক্ষমেলায় সবুজের আহ্বান 

বৃক্ষমেলায় আসা লম্বা লম্বা টুকটুকে এ আমের নাম চিয়াং মাই
ছবি: লেখক

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৮ সালে শান্তিনিকেতনে ছাত্র–শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে মহাধুমধাম করে গাছ লাগাতে শুরু করেন। গাছ লাগানোর সেই চর্চা ধীরে ধীরে শান্তিনিকেতনের বার্ষিক বৃক্ষরোপণ উৎসবে পরিণত হয়। ধীরে ধীরে সে উৎসবের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে শান্তিনিকেতনের বাইরেও।

এ দেশে প্রতিবছর পয়লা আষাঢ় থেকে শুরু হয় বৃক্ষরোপণ অভিযান। তবে একে অভিযান না বলে উৎসব বললেই বোধ করি যথার্থ শোনায়। গাছ লাগানোর মধ্যে যে একটা আনন্দ আছে, তার ভাব আসে। প্রতিবারের মতো এ বছরও ৫ জুন থেকে ঢাকার শেরেবাংলা নগরে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে শুরু হয়েছে মাসব্যাপী জাতীয় বৃক্ষমেলা। এবারের মেলায় ৭৩টি বেসরকারি নার্সারি, প্রতিষ্ঠানসহ অংশ নিয়েছে কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান।

বৃক্ষমেলার সুদৃশ্য প্রবেশপথ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে ডান দিকে যেতেই অনুভূতিটা হলো এমন, যেন এক উদ্যানের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলেছি। চারদিকে কেবল সবুজ আর সবুজ। স্টলের ভেতরে ও বাইরের মাঠে মনোরম করে সাজানো নানা রকমের সুদৃশ্য গাছ। ড্রামের ভেতরে রাখা আমগাছগুলোতে ধরেছে রংবেরঙের বাহারি আম, নানা রঙের ফুল আর বাহারি পাতা।

আশুলিয়া থেকে আসা হোসেন নার্সারির সামনে ঝুলছে শতাধিক লম্বা লম্বা টুকটুকে থোকায় থোকায় বেশ বড়সড় আম। তাঁরা বললেন, চিয়াংমাই জাতের এই আম মেলায় এবার তাঁরা নতুন এনেছেন। পাশের বেলি গার্ডেন নার্সারিতেও এই একই জাতের আম, তবে রংটা গোলাপি লাল। আরও কয়েকটা নার্সারিতেও শোভা পাচ্ছে এই আম। আছে লটকন, রাম্বুটান, ত্বীন, থাই সফেদা, সাদা জাম আর করমচা ফলও।

ড্রামের গাছ দেখে মনে হলো, ওগুলো ছাদবাগানের কথা ভেবেই তৈরি করা। নগরের মেলা। তাই নগরবাসীই আসবেন। এই বৃক্ষমেলার চারা আর কলম যাবে নগরের বিভিন্ন বাগানে। সেদিকে লক্ষ রেখেই নার্সারি ব্যবসায়ীরা গাছপালা এনেছেন।

তবে এর মধ্যেও ব্যতিক্রম গ্রীন স্পেস। তাদের কাছে রয়েছে দেশি-বিদেশি নানা জাতের অর্কিড আর ক্যাকটাস, সাকুল্যান্ট, এমনকি ঢাউস পাতার বার্ড নেস্ট ফার্ন। গ্রীন স্পেসের চঞ্চল কুমার তরফদার বললেন, কিছু অর্কিড সংগ্রহ করা হয়েছে কাপ্তাইয়ের জঙ্গল থেকে। তবে তাঁরা এ বৃক্ষমেলায় এনেছেন বৈলাম, বুদ্ধ নারকেল, সিভিট, কইনার, কাইঞ্জাল ভাদি, ধুলি গর্জন, উদাল, উরিআম, কামদেব, পুত্রঞ্জীব, পুন্নাল, করচ, তেজবল, চালমুগরা, ধারমারা, ঢাকিজাম, মহুয়া, কাউফল ইত্যাদি বিপন্ন ও বিপদাপন্ন গাছের চারা। প্রতিটি চারা বিক্রি করছেন ১০০ টাকা করে।

কৃষিবিদ উপকরণ নার্সারি ১৯৯৩ সাল থেকে নিয়মিতভাবে অংশ নিচ্ছে মেলায়। চারার পাশাপাশি বিক্রি করছে গাছপালার বই, বীজ, সার ইত্যাদি। অন্যান্য নার্সারি ঘুরে দেখা মিলল নানা রঙের অলকানন্দা ফুলের; দুর্লভ গাছ হংসলতার; সুগন্ধি জুঁই, মালতীলতা, বাগানবিলাস, মধুমঞ্জরি, ম্যান্ডেভিলা ইত্যাদি ফুলের। জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের স্টলের সামনে বহু গাছপালার সঙ্গে দেখা মিলল বিশাল পাতার জলজ গাছ আমাজান লিলির।

দেখে মনে হলো, বৃক্ষমেলায় অধিকাংশ নার্সারির ব্যবসায়িক লক্ষ্য কেবল নগরীর মানুষ, বিশেষ করে ছাদবাগানিদের। ব্যতিক্রম সামান্য। গাছ লাগানোর নানা তথ্য ও প্রযুক্তিগত সেবা দিয়ে সহায়তা করছে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। পাশাপাশি কিছু বেসরকারি সংস্থা সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে এসেছে বৃক্ষরোপণে, পরিবেশ বাঁচানোয়। বাংলাদেশ বন্ধু ফাউন্ডেশন (বন্ধু) সংস্থার গোলাম কিবরিয়া জানালেন, তাঁরা ২০২৪ সালের মধ্যে সারা দেশে ৫০ প্রজাতির দুই কোটি গাছ লাগানোর প্রকল্প নিয়েছেন। গাছ লাগানোর জন্য প্রকল্প থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

বৃক্ষমেলায় এই বিপুল পরিমাণে সবুজের সমারোহ দেখে ফেরার সময় রবীন্দ্রনাথের বৃক্ষরোপণ উৎসব কবিতার ভাষায় বলতে ইচ্ছা করল, ‘আয় আমাদের অঙ্গনে,/ অতিথি বালক তরুদল,/ মানবের স্নেহসঙ্গ নে,/ চল্, আমাদের ঘরে চল।’

বৃক্ষমেলা থেকে আমাদের আঙিনায় নিয়ে যাব প্রত্যেকে অন্তত তিনটি গাছ, সেখানে তাকে ঠাঁই দিয়ে করজোরে বলব, ‘তরুতরুণেরে করুণায় করো ধন্য,/ দেবতার স্নেহ পায় যেন এই বন্য।’