বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুন: হাসপাতালের বিছানায় সন্তানেরা, ক্ষোভ ঝাড়লেন দুই বাবা

২৬ জানুয়ারি আসিফ-নাতাশার প্রথম বিবাহবার্ষিকী। এখন আসিফ হাসপাতালের শয্যায় আর নাতাশা নিখোঁজ
ছবি: সংগৃহীত

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ৫২০ নম্বর কক্ষে চিকিৎসাধীন আসিফ মোহাম্মদ খান (৩০)। চিকিৎসক জানিয়েছেন, তাঁর শ্বাসনালি ও শরীরের ৮ শতাংশ পুড়ে গেছে। ছেলেকে দেখতে এসে শারীরিক অবস্থার কথা স্বজনদের জানাচ্ছিলেন বাবা আবু সিদ্দিক খান। ওই সময় সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গেলে ক্ষোভে ফেটে পড়েন তিনি।

এই বাবা বলেন, ‘আমি কারও সঙ্গে কথা বলব না। একবার পুলিশ এসে জিজ্ঞেস করে ছেলে রাজনীতি করে কি না! একবার আপনারা কথা বলেন! যা বলার সব পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছি। আমার ছেলে রাজনীতির সঙ্গে কখনোই জড়িত না।’

আবু সিদ্দিক খানের ছেলে আসিফ খান ও তাঁর স্ত্রী নাতাশা জেসমিন বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী ছিলেন। আসিফ দগ্ধ অবস্থায় ট্রেন থেকে বের হতে পারলেও স্ত্রী নাতাশাকে তিনি বের করতে পারেননি। পরিবার বলছে, নাতাশা বেঁচে আছেন, এটা যেন হয়। তবে তাঁরা যতটুকু শুনছেন, তাতে নাতাশা আর বেঁচে নেই বলেই মনে হচ্ছে।

গতকাল শুক্রবার যশোরের বেনাপোল থেকে যাত্রী নিয়ে ট্রেনটি ঢাকায় আসছিল। কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছানোর অল্প কিছুক্ষণ আগে রাত নয়টার দিকে গোপীবাগ কাঁচাবাজারের সামনে ট্রেনে আগুন লাগে। এতে তিনটি কোচ পুড়ে যায়। পাশাপাশি একটি পাওয়ার কারও পুড়েছে। এ দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত চারজনের লাশ পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে কারও পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

ক্ষোভ সামলে কিছুটা শান্ত হওয়ার পর কথা হয় বাবা আবু সিদ্দিক খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, আসিফ জানালা দিয়ে কোনো রকমে বের হতে পেরেছিলেন। নাতাশা তাঁর সঙ্গেই ছিলেন। কিন্তু ভিড়ের চাপে স্ত্রীকে নিয়ে আসিফ বের হতে পারেননি।

এই দম্পতি ফরিদপুরের ভাঙ্গায় ঘুরতে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে এ ঘটনার শিকার হন। আসিফ নর্থ ভিশন নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিপণন নির্বাহী হিসেবে কর্মরত। আসছে ২৬ জানুয়ারি আসিফ-নাতাশার প্রথম বিবাহবার্ষিকী।

শ্বশুর , শাশুড়ি, দেবর ও স্বামীর (বায়ে) সঙ্গে নাতাশা (ডানে)
ছবি: সংগৃহীত

সম্পর্কে আসিফের চাচা হন মির্জা আরাফাত। হাসপাতালে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আসিফের পুরো পরিবার রাজধানীর পুরান ঢাকার নারিন্দায় থাকেন। আসিফ পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছেন, কোচের দরজা–জানালা বন্ধ ছিল। পাশের কোচটি ছিল শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। আগুন লাগার পর যাত্রীরা ওই কোচে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেটির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ থাকায় ঢুকতে পারেননি। নিজেদের কোচের জানালাগুলো সবাই চাপাচাপি করে অর্ধেকটা খুলতে পারার পর যাত্রীরা জানালা দিয়ে লাফ দেন।

যার যার স্বার্থ উদ্ধারের জন্য আগুন লাগাচ্ছে

৫২০ নম্বর কক্ষে চিকিৎসাধীন রয়েছেন মো. মাসুদ আলমের ছেলে নাফিস আলমও (২২)। নাফিস ফরিদপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে প্রকৌশল বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি নিয়েছেন। ১ জানুয়ারি একটি বেসরকারি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানে ‘জুনিয়র ইমপ্লিমেনটেশন ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে যোগ দিয়েছেন। দুই বোন এক ভাইয়ের মধ্যে নাফিস দ্বিতীয়।

ইনস্টিটিউটের ৫২০ নম্বর কক্ষের সামনে রোগীদের স্বজনেরা। তাদের মধ্যে রয়েছেন নাফিসের বাবা মাসুদ আলমও (বাঁ থেকে দ্বিতীয়)
ছবি: প্রথম আলো

কক্ষের বাইরের আসনে বসেছিলেন নাফিসের বাবা মাসুদ আলম। তিনি ফরিদপুর সদরের বাইশরশি শিবসুন্দর একাডেমির এসএসসি ভোকেশনাল শাখার ইনচার্জ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত ১০ অক্টোবর পদ্মা সেতু দিয়ে রেল চলাচল শুরুর পর ছেলে সব সময়ই ট্রেনেই আসা যাওয়া করছেন। তিনি ভোটের পর ছেলেকে আসতে বললেও নতুন চাকরি বলে ছেলে চলে আসেন। আজ শনিবার তাঁর অফিস খোলা ছিল। বাসা থেকে একটি কম্পিউটার নিয়ে ট্রেনে উঠেছিলেন। তিনি ছেলেকে ট্রেনে উঠিয়ে দেন। রাত সাড়ে নয়টায় ছেলে তাঁকে ফোন দিয়ে বলেন, ‘আব্বু আমি নিরাপদ আছি। কম্পিউটারটা পুড়ে গেছে।’

মাসুদ আলম জানান, ছেলের ডান হাত, বাঁ কান ও কোমর সামান্য পুড়েছে। শ্বাসনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর জানালা দিয়ে লাফিয়ে নামার কারণে হাঁটু ছিলে গেছে। চিকিৎসক জানিয়েছেন, নাফিসের শরীরের ৫ শতাংশ পুড়ে গেছে।

আগুন দেওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে এই বাবা বলেন, ‘স্বার্থ উদ্ধারের জন্য যার যা করা দরকার, তাই করছে। আর সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা সাধারণ মানুষ। সাধারণভাবে জীবন কাটাতে চাই।’

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন মো. তরিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ট্রেনে দগ্ধ হয়ে আটজন এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বাহ্যিকভাবে তাঁদের পোড়া কম হলেও সবার শ্বাসনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাঁদের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এ জন্য অক্সিজেন দিয়ে রাখা হচ্ছে।