বর্জ্যে ভরা খাল, নেই পানির প্রবাহ

ময়লা–আবর্জনায় ভরে গেছে, সরু হয়ে এসেছে পানির প্রবাহ। রাজধানীর মিরপুর এলাকার রূপনগর খালের ছবিটি সম্প্রতি তোলাপ্রথম আলো

কোথাও খাল ঢাকা পড়েছে ময়লা-আবর্জনায়। কোথাও বর্জ্য জমাট বেঁধে জন্মেছে আগাছা। চট করে দেখে খাল নয়, মনে হবে ভাগাড়। জমে থাকা বর্জ্যের কারণে খাল প্রবাহিত হচ্ছে সরু নালার মতো। তবে কিছু খালে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো ও খননকাজ করায় পানির প্রবাহ ফিরেছে।

রাজধানীর উত্তরা সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকার বেশির ভাগ খালের চিত্র এ রকম। গত জুনের মাঝামাঝি সময় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আওতাধীন ১৩টি খালের বিভিন্ন অংশে সরেজমিনে এমন চিত্র দেখা গেছে। যদিও সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের দাবি, ২৯টি খালের বেশির ভাগই পরিচ্ছন্ন ও পানির প্রবাহ রয়েছে।

প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক গত ১২, ১৩ ও ১৪ জুন মিরপুরের রূপনগর খাল, আরামবাগ খাল, সাংবাদিক কলোনি খাল, প্যারিস রোড খাল, বাইশটেকি খাল, বাউনিয়া খাল, ইব্রাহিমপুর খাল, কল্যাণপুর মূল খাল, কল্যাণপুর–খ (গোদাখালী) খাল, কল্যাণপুর–ঘ (বগার মা) খাল, মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর খাল, কাটাসুর খাল ও হাইক্কার খাল সরেজমিনে দেখে এসেছেন। এর মধ্যে মোহাম্মদপুরের হাইক্কার খালটির অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।

পরিষ্কারের তথ্যে গরমিল

গত ২৯ মে ঢাকায় ভোর থেকে হওয়া বৃষ্টি চলে মাঝরাত পর্যন্ত। ওই বৃষ্টিতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।  রাতে চরম দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী। পরদিনও ঢাকা উত্তরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা ছিল। ঘরে কোমরসমান পানি জমে থাকায় মিরপুরের কালশীতে একটি বস্তির বাসিন্দাদের কালশী উড়ালসড়কের নিচে আশ্রয়ও নিতে হয়েছিল।

৩০ মে বিকেলে ডিএনসিসির জনসংযোগ বিভাগের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রশাসকের বরাতে বলা হয়, ঢাকা উত্তর সিটিতে ২৯টি খালের ১০০ কিলোমিটারের বেশি এলাকা দখলমুক্ত করে পানির প্রবাহ সৃষ্টি করা হয়েছে।

কিন্তু ডিএনসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্যে, ২৯টি খালের মোট দৈর্ঘ্যই যেখানে ৯৮ কিলোমিটার, সেখানে ১০০ কিলোমিটারের বেশি পরিষ্কার কীভাবে করা হয়েছে? এর স্পষ্ট ব্যাখ্যা জনসংযোগ বিভাগ থেকে পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজের দাবি, বক্তব্যটা ছিল দুই সিটি করপোরেশন মিলিয়ে ১০৮ কিলোমিটারের কাজ (খাল খনন ও পরিষ্কার) করা হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় ১১২ কিলোমিটার খাল নেটওয়ার্কের কাজ শেষ হয়েছে। এ অংশে খাল পরিষ্কার, খনন এবং উদ্ধার করা হয়েছে।

আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ ভবনের পেছনের অংশে কল্যাণপুর খালের উজানে আবর্জনা ও আগাছায় ভরে গেছে। সম্প্রতি তোলা ছবি
প্রথম আলো

ময়লা-আবর্জনায় ঠাসা

সরেজমিনে ১৩টি খালের মধ্যে ৮টি খালের বিভিন্ন অংশে ময়লা-আবর্জনা জমে থাকতে দেখা গেছে। মিরপুর-৭ নম্বর সেকশনের আরামবাগ আবাসিক এলাকার পাশে আরামবাগ খালে গিয়ে দেখা যায়, খালটি ময়লা-আবর্জনায় ঠাসা। রূপনগর সড়ক অংশ থেকে খালের উজানে প্রায় ১০০ মিটার এলাকায় বর্জ্যের কারণে পানি দেখা যায়নি। পলিথিন, প্লাস্টিক, বিভিন্ন পণ্যের মোড়ক, কর্কশিটের বাক্স—কী নেই ওই খালে!

স্থানীয় বাসিন্দা মেহেদী আহম্মেদ জানালেন, দীর্ঘদিন তিনি করপোরেশনের কোনো কর্মীকে ওই খাল পরিষ্কারের কাজ করতে দেখেননি।

আরামবাগ খালের প্রায় দেড় শ মিটার দূরে রূপনগর খাল। খালটির রূপনগর টিনশেড আবাসিকের ৫ নম্বর সড়কের প্রান্তে ১১৩/সি বাড়ির পাশে গিয়ে দেখা যায়, উজান ও ভাটি দুই দিকেই ময়লা-আবর্জনায় খালের প্রবাহ অর্ধেক হয়ে গেছে। সেখান থেকে প্রায় সোয়া তিন শ মিটার ভাটিতেই ইস্টার্ন হাউজিংয়ের প্রধান ফটকে খালে বর্জ্যে ঠাসা।

সেতুর পাশের দোকানি রমজান মিয়া জানালেন, চার-পাঁচ মাস আগে করপোরেশনের কিছু কর্মীকে খাল পরিষ্কার করতে দেখেছিলেন। কিন্তু তাঁরা যেভাবে চিরুনি আকৃতির লোহার কাঁটা দিয়ে খালের আবর্জনা টেনে পাড়ে তোলেন, তাতে খাল খুব একটা পরিষ্কার হয় না।

মিরপুরে বাইশটেকি খালের দুটি অংশে বর্জ্যের স্তূপ দেখা গেছে। খালটির জয়নগর সরকারি কর্মকর্তা আবাসনের পাশে  করপোরেশনের এসটিএসের পেছনে খালে ময়লা-আবর্জনা ভরে ছিল। পল্লবীর আলমনগর অংশে খালটি সরু নালার মতো। ওই অংশের খালও ময়লা-আবর্জনায় ভরা।

শ্যামলীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) পাশ থেকে খালের একটি অংশ কল্যাণপুর মূল খালের সঙ্গে মিশেছে। খালের এ অংশ কল্যাণপুরের শাখা খালগুলোর একটি। খালটির বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ ভবনের পেছনের অংশে উজানের দিকে আবর্জনা ও আগাছায় ভর্তি দেখা গেছে। এ অংশে পানি দৃশ্যমান নয়, খালটি প্রায় মৃত।

মোহাম্মদপুর এলাকার রামচন্দ্রপুর খালের মোহাম্মদিয়া হাউজিং লিমিটেডের ১ নম্বর সড়কের সেতু অংশে খালে বর্জ্য জমে ছিল। গাবতলী-সদরঘাট বেড়িবাঁধ সড়কের পশ্চিমে সাতমসজিদ হাউজিং এলাকায় খালের আরেক অংশে ঘাস ও আগাছায় ভরা।

তুলনামূলক পরিষ্কার ৫ খাল

সরেজমিনে ঢাকা উত্তর সিটির ১৩ খালের মধ্যে ৫টি খাল তুলনামূলক পরিষ্কার দেখা গেছে। এ খালগুলো হচ্ছে মিরপুরের সাংবাদিক কলোনি খাল, বাউনিয়া খাল, ইব্রাহিমপুর খাল, কল্যাণপুর–খ (গোদাখালী) খাল এবং কল্যাণপুর–ঘ (বগার মা) খাল। এ খালগুলোতে ময়লা-আবর্জনা জমে থাকতে দেখা যায়নি। খালে পানির প্রবাহও দেখা গেছে।

এর মধ্যে গত ২ ফেব্রুয়ারি মিরপুরের বাউনিয়া খালের পরিষ্কার ও খননকাজের উদ্বোধন করেছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের তিন উপদেষ্টা। সরেজমিনে খালটি আগের চেয়ে পরিষ্কার দেখা গেছে। মিরপুর-১৪ নম্বর ডেন্টাল কলেজ অংশ থেকে মিরপুরের রূপসী প্রো-অ্যাকটিভ ভিলেজ আবাসিক এলাকা অংশ পর্যন্ত খালে ময়লা-আবর্জনা জমে থাকতে দেখা যায়নি।

ডিএনসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সূত্রে, বাউনিয়া খালের দৈর্ঘ্য ৮ কিলোমিটার, প্রস্থ ১৮-২৫ মিটার। অর্পিত ক্রয়কার্য প্রক্রিয়ায় এ খালের ২ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার অংশের পরিষ্কার ও খননকাজ বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে দিয়ে করানো হয়েছে।

এ ছাড়া মিরপুর-১১ নম্বর সেকশন এলাকার সাংবাদিক খাল, ইব্রাহিমপুর খাল ও কল্যাণপুর–খ (গোদাখালী) ও কল্যাণপুর–ঘ (বগার মা) খাল পরিষ্কার দেখা গেছে। মিরপুরের পশ্চিম কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়া, আগারগাঁওয়ের তালতলা, কল্যাণপুর ও দারুসসালাম এলাকা দিয়ে কল্যাণপুর-ঘ খাল বা বগার মা খাল প্রবাহিত হয়েছে। এ খালেও ভাসমান বর্জ্য দেখা যায়নি, খালে পানির প্রবাহও ছিল।

মোহাম্মদপুরের কাদেরাবাদ আবাসিক এলাকার পেছনে ৫ নম্বর সড়কের সেতু অংশে কাটাসুর খাল বর্জ্যে ঠাসা। পানির প্রবাহ না থাকায় খালের এ অংশ মৃতপ্রায়। সম্প্রতি তোলা ছবি
প্রথম আলো

ঢাকা উত্তর সিটির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ খালের বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সপ্তাহখানেকের মধ্যেই মানুষ ময়লা-আবর্জনা ফেলে খাল ভরে ফেলে। পাশাপাশি খালে পয়োবর্জ্য যায়। তাই খাল পরিষ্কারের কাজ ধারাবাহিকভাবে সারা বছর করতে হবে। প্রতিবছর খালের পেছনে প্রায় শতকোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ রাখা হলেও তুলনামূলক কম খরচ করা হয়েছে।

 খালের সংখ্যা নয়, কতটুকু খাল পরিষ্কার ও সচল করা হয়েছে, সেটা প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়—উল্লেখ করে উত্তর সিটির প্রশাসক বলেন, প্রথমে লক্ষ্য ছিল ঢাকার ২২ কিলোমিটার খাল পরিষ্কার ও খনন করা। প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়ে তিনি দুই সিটির বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে খালের কাজ এগিয়ে নিয়েছেন। ঢাকার প্রায় ২২০ কিলোমিটার খাল নেটওয়ার্কের পুরোটাই উদ্ধার করা হবে।