নেতার কারণে তিন দিন ইন্টারনেট–বঞ্চিত মানুষ

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কিছু এলাকার মানুষ তিনদিন ধরে ইন্টারনেট সেবা থেকে বঞ্চিত। অভিযোগ উঠেছে, যুবলীগের সাবেক নেতা আরিফুর রহমান স্থানীয় ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নিতে লোকজন দিয়ে তার কেটে দিয়েছেন

কেটে দেওয়া ইন্টারনেট সংযোগের তার সড়কে পড়ে রয়েছে। মোহাম্মদপুরের মনসুরাবাদ হাউজিং এলাকার চিত্র। ঢাকা, ১৩ অক্টোবর
ছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কিছু এলাকার ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগের কেব্‌ল (তার) গত মঙ্গলবার কেটে দেওয়া হয়। ফলে আজ শুক্রবার পর্যন্ত টানা তিন দিন ওই সব এলাকার বাসিন্দারা ইন্টারনেট–সেবা থেকে বঞ্চিত। অভিযোগ উঠেছে যে আদাবর থানা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক আরিফুর রহমান তাঁর বন্ধুর এবং পছন্দের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে ইন্টারনেটের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার উদ্দেশ্যে এসব সংযোগ কাটিয়েছেন।

তবে আজ শুক্রবার বিকেলে আরিফুর রহমানকে কেব্‌ল অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (কোয়াব) নেতাদের মাধ্যমে ডেকে নেন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) নেতারা। সবার অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে আজ শুক্রবার রাত থেকেই সংযোগ পুনরায় দেওয়ার কাজ শুরু হবে। এ ছাড়া আরিফুর রহমানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি) লিখিত অভিযোগ জানানো হবে।

অভিযুক্ত আরিফুর রহমান আদাবর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী। তিনি বৃহত্তর মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রলীগ এবং সাবেক ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

আইএসপিএবি, স্থানীয় ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ও ইন্টারনেট ব্যবহারকীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আরিফুরের নির্দেশে মঙ্গলবার দুপুরের দিকে ইন্টারনেটের কেব্‌ল কাটেন তাঁর (আরিফুর) কেব্‌ল টিভির (ডিশ টিভি) সংযোগ প্রদানের প্রতিষ্ঠান বিএসিটিভিএনের কর্মীরা। ফলে ওই দিন দুপুর থেকেই মোহাম্মদপুরের আদাবর, বায়তুল আমান হাউজিং, মনসুরাবাদ হাউজিং, সুনিবিড় হাউজিং এলাকা এবং শেখেরটেকের কয়েকটি সড়কের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট-সেবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কেব্‌ল কাটার প্রতিবাদে আইএসপিএবি ইন্টারনেট পুনঃসংযোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকে। ফলে আজ শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা তিন দিন ওই সব এলাকার বাসিন্দারা ইন্টারনেট–সেবা থেকে বঞ্চিত হন। এর মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে ওই এলাকায় মুঠোফোনের ইন্টারনেট–সেবাও ফোর-জি থেকে থ্রি-জিতে নেমে আসে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ কেউ।

আমাদের কাছে প্রমাণ আছে। তাঁর (আরিফুর) প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক অপু ও কর্মীরা মিলে যে তার (কেব্‌ল) কেটেছেন। এর ভিডিও আমাদের কাছে আছে। সেগুলো তাঁকে দেখিয়েছি। তখন আরিফুর বলেছেন, ‘আমি নির্দেশ দিইনি। আমার লোক করে ফেলেছে।’
ইমদাদুল হক, সভাপতি, আইএসপিএবি

মোহাম্মদপুরের আদাবর, বায়তুল আমান হাউজিং ও মনসুরাবাদ হাউজিং এলাকায় আজ দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন জায়গায় ইন্টারনেট সংযোগের তার কেটে রাখা হয়েছে। কোথাও কোথাও তার নিচে পড়ে আছে। কোথাও আবার কেটে দেওয়া তার নিচু হয়ে ঝুলে আছে। কেটে রাখা তারের কারণে ফুটপাত দিয়ে হাঁটাচলায় সমস্যা হচ্ছে পথচারীদের।

বায়তুল আমান হাউজিংয়ের বাসিন্দা বজলুর রহমান বলেন, ‘তিন দিন ধরে কোনো ইন্টারনেট নেই। কোম্পানিতে ফোন করেছিলাম। তারা জানিয়েছে, দলীয় লোকজন তার কেটে দিয়েছেন। সংযোগ দিতে দিচ্ছেন না। পরে সংবাদে দেখলাম যে যুবলীগ নেতা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নিতে এমন করেছেন।’

মনসুরাবাদ হাউজিংয়ের বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন, যুবলীগ নেতার কাছে সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে গেছেন। তাঁর ব্যবসায়িক ইচ্ছার কারণে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। রাজধানীর মতো একটা জায়গার কিছু এলাকায় টানা তিন দিন ইন্টারনেটের সংযোগ বন্ধ, এটা নজিরবিহীন।

কেটে দেওয়া ইন্টারনেট সংযোগের তার। বায়তুল আমান হাউসিংয়ের ৮ নম্বর সড়কের চিত্র। মোহাম্মদপুর, ঢাকা, ১৩ অক্টোবর
ছবি: প্রথম আলো

আজ বিকেলে আইএসপিএবি ও কোয়াবের নেতারা আরিফুর রহমানকে নিয়ে বৈঠকে বসেন। বৈঠক শেষে সন্ধ্যায় আইএসপিএবির সভাপতি ইমদাদুল হক মুঠোফোনে প্রথম আলোকে জানান, বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজ শুক্রবার রাত থেকেই ইন্টারনেট সংযোগ পুনরায় দেওয়ার কাজ শুরু হবে। আরিফুর রহমানের বিরুদ্ধে বিটিআরসিতে লিখিত অভিযোগ জানানো হবে।

আরিফুর রহমান তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন জানিয়ে ইমদাদুল হক বলেন, ‘আমাদের কাছে প্রমাণ আছে। তাঁর (আরিফুর) প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক অপু ও কর্মীরা মিলে যে তার (কেব্‌ল) কেটেছেন। এর ভিডিও আমাদের কাছে আছে। সেগুলো তাঁকে দেখিয়েছি। তখন আরিফুর বলেছেন, “আমি নির্দেশ দিইনি। আমার লোক করে ফেলেছে।”’

আইএসপিএবির সভাপতি আরও বলেন, যুবলীগ নেতা আরিফুর রহমান ওই এলাকায় তাঁর এক বন্ধুর ইন্টারনেট–সেবার প্রতিষ্ঠান ইউনিভিশনের টেকনোলজির মাধ্যমে এই ব্যবসার দখল নিতে চান। এ ছাড়া আরও কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যাদের লাইসেন্স নেওয়া আছে, কিন্তু সেখানে ব্যবসা নেই। তারাও ইন্ধন দিয়ে থাকতে পারে। এটাই কেব্‌ল কেটে ফেলার আসল উদ্দেশ্য।

আমি পলিটিকস (রাজনীতি) করি তো, দোষ দিতেই থাকে। কিছু করার নেই। লাইন কাটাকাটি যেটা হয়েছে, এটা ইন্টারনালি (অভ্যন্তরীণ) হয়েছে। কর্মীরা করে মালিকদের বিপদে ফেলেছে।
আরিফুর রহমান, যুবলীগের সাবেক নেতা

তবে আরিফুর রহমান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি পলিটিকস (রাজনীতি) করি তো, দোষ দিতেই থাকে। কিছু করার নেই। লাইন কাটাকাটি যেটা হয়েছে, এটা ইন্টারনালি (অভ্যন্তরীণভাবে) হয়েছে। কর্মীরা করে মালিকদের বিপদে ফেলেছে।’ আলোচনার সিদ্ধান্তের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি ইন্টারনেট (ব্যবসা) করি না, করবও না। এটা আমি পরিষ্কার করে দিয়ে আসছি।’

এর আগে মঙ্গলবার আইএসপিএবি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছিল, ‘কেব্‌ল টিভি ব্যবসায়ী আরিফুর রহমান আদাবরের বায়তুল আমান হাউজিং, মনসুরাবাদ হাউজিং, সুনিবিড় হাউজিং এলাকার সব ধরনের ইন্টারনেট-সংযোগ এককভাবে দখলের জন্য গত ৩১ জুলাই এবং ১০ অক্টোবর সব ইন্টারনেট কেব্‌ল কেটে দেয়। ওই এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ পুনরায় চালু করতে গেলে তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে বিতাড়িত করা হয়।’ তাই এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ওই এলাকায় সব ধরনের ইন্টারনেট পুনঃসংযোগ বন্ধ থাকবে। কেব্‌ল কেটে দেওয়ায় আদাবর এলাকার প্রায় ১৫ হাজার গ্রাহকের ইন্টারনেট-সেবা বন্ধ রয়েছে বলেও জানানো হয়েছিল।

ওই এলাকায় ইন্টারনেটের ব্যবসা করেন মাসুদ রানা। সংযোগ কাটায় তাঁর ইউনিক নেট নামের প্রতিষ্ঠানের দুই শতাধিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০২২ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত অনেকবার তিনি (আরিফুর) কোনো আলাপ–আলোচনা ছাড়াই কেব্‌ল কেটেছেন। তাঁর নির্দেশে তার কাটা হয়। আমাদের কর্মীরা পুনঃসংযোগ দিতে গেলে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়। কিছু কর্মীদের নির্যাতনও করা হয়েছে।’

স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের একাধিক নেতা এবং ওই এলাকায় ইন্টারনেট–সেবা প্রদানকারী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যুবলীগ নেতা আরিফুর রহমান মূলত কেব্‌ল টিভির ব্যবসা করেন। এই ব্যবসায় আরিফুরের অংশীদার হচ্ছেন কামরুল হাসান। আর কামরুলের ছোট ভাই সুমন ও রানা মিলে পরিচালনা করেন ইন্টারনেট সংযোগের প্রতিষ্ঠান ইউনিভিশন টেকনোলজি। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আরিফুর ইন্টারনেটের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছে আইএসপিএবি।

রাতে ওই প্রতিষ্ঠানের মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে ইউনিভিশনের মালিক সাইদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ইন্টারনেট সংযোগ কেটে দেওয়ার ঘটনার প্রতিবাদে তিনি সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন।