জলাভূমি, গাছপালা উজাড়, ঢাকায় শৈত্যপ্রবাহ আসে না

ঢাকা পরিণত হচ্ছে উষ্ণ নগরে। গ্রীষ্মে গরম বেশি, শীতে শীত কম। ২০১৮ সালের পর শৈত্যপ্রবাহ আসেনি। 

  • সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার নিচে নামলে তাকে শৈত্যপ্রবাহ হিসেবে গণ্য করা হয়। 

  • এক যুগে ঢাকায় প্রতি তিন বছরে একটি শৈত্যপ্রবাহ হয়েছে। 

২০ জানুয়ারি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের তাপমাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা গত তিন বছরের মধ্যে দেশের সর্বনিম্ন। কুয়াশা আর কনকনে ঠান্ডার মধ্যে হরেক রকম পণ্য নিয়ে সাইকেলে রওনা দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ এক বিক্রেতা। গ্রামে গ্রামে হেঁটে ফেরি করে পণ্য বিক্রি করেন তিনি। শ্রীমঙ্গলের কালীঘাট সড়কে গতকাল সকাল পৌনে আটটায়
ছবি: শিমুল তরফদার

‘মাঘের শীতে বাঘ পালায়’, এটা প্রবাদ। মাঘ মাসের ৯ দিন চলে গেছে। কিন্তু ঢাকায় এখনো ‘বাঘ পালানো’ শীতের দেখা নেই। অর্থাৎ রাজধানীতে শৈত্যপ্রবাহ আসেনি। জানুয়ারি মাসের প্রথম ভাগে ঢাকায় যে শীত পড়েছিল, আবহাওয়া অধিদপ্তরের মাপকাঠিতে তা শৈত্যপ্রবাহ নয়।

শুধু এ মৌসুম নয়, রাজধানীতে ২০১৮ সালের পর আর শৈত্যপ্রবাহ আসেনি। ২০১২ সাল থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ঢাকার ওপর দিয়ে চারটি শীত মৌসুমে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গেছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, প্রতি তিন বছরে এক মৌসুমে শৈত্যপ্রবাহ হচ্ছে। সব মিলিয়ে ঢাকা একটি উষ্ণ নগর হয়ে উঠেছে, যেখানে গ্রীষ্মকালে গরম বেশি পড়ে, শীতকালে শীত অনুভূত হয় কম।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা উষ্ণ নগর হয়ে ওঠার বড় কারণ জলাভূমি ও গাছপালা উজাড় হয়ে যাওয়া এবং ভবন ও যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি। ঢাকার বায়ুদূষণও শীত আসতে বাধা দেয়।

শীতকালেও ঢাকার তাপমাত্রা গ্রামের চেয়ে তিন থেকে চার ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি থাকায় বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। এটা অর্থনীতিতে চাপ বাড়াচ্ছে।
ম তামিম, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ

জানতে চাইলে অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও জলবায়ু গবেষক আশরাফ দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা শহরের অপরিকল্পিত নগরায়ণ এখানকার সুন্দর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে ফেলেছে। যে কারণে এখানে শীতকালে শৈত্যপ্রবাহ আসে না। দেশের বিভিন্ন স্থানে বছরের বড় সময়জুড়ে রাতে হালকা ঠান্ডা পড়ে। ঢাকায় শীতকাল ছাড়া বাকি সময়জুড়ে দিন ও রাতে একই ধরনের উত্তাপ বা গরম অনুভূত হয়। তিনি বলেন, এখনই ঢাকা শহরের যতটুকু এলাকায় সবুজ ও জলাভূমি টিকে আছে, তা রক্ষা করতে হবে।

তখন, এখন

সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার নিচে নামলে তাকে শৈত্যপ্রবাহ হিসেবে গণ্য করে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তাদের মাপকাঠি হলো সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস মানে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। ৬ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা থাকলে তাকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ হিসেবে ধরা হয়। আর তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হিসেবে গণ্য করা হয় তাপমাত্রা ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে।

এরও কম তাপমাত্রার মানে হলো অতি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ। এটা বাংলাদেশে খুব কম হয়। ২০১৮ সালের ৮ জানুয়ারি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা নেমেছিল ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা ৩০ বছরের মধ্যে দেশের সর্বনিম্ন ছিল।

রাজধানীতে চলতি শীত মৌসুমে এখন পর্যন্ত সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার নিচে নামেনি। ঢাকার মাত্র ১৪০ কিলোমিটার দূরে শ্রীমঙ্গলে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামার ঘটনা ঘটেছে। ঢাকার আশপাশের প্রায় সব জেলায় একাধিকবার শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গেছে।

ঢাকায় সর্বশেষ ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে তাপমাত্রা ৯ দশমিক ৫ ডিগ্রিতে নেমেছিল। এর আগে শৈত্যপ্রবাহ হয়েছিল ২০১৬ সালে। ব্যপ্তি ছিল একদিন। ২০১৩ সালে শৈত্যপ্রবাহ হয়েছিল ছয় দিন। ২০১২ সালের শীত মৌসুমেও একটি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যায় ঢাকার ওপর দিয়ে।

সাধারণ বাংলাদেশে শৈত্যপ্রবাহ প্রবেশ করে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া ও মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল দিয়ে। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে শীতল বাতাসের এই প্রবাহ ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারির মধ্যে কয়েকবার ঢাকার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার কথা। সেটাই হতো। কিন্তু আশির দশক থেকে ঢাকায় শীতের তীব্রতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাছে ১৯৫৩ সাল থেকে ঢাকাসহ কয়েকটি জেলার সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ তাপমাত্রার তথ্য সংরক্ষিত আছে। সেই তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৫৩ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ঢাকায় জানুয়ারি মাসে ১০ থেকে ২০ দিন করে শৈত্যপ্রবাহ থাকত। যেমন ঢাকায় ১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাসে ১৫ দিন ও ১৯৫৪ সালে ২০ দিন শৈত্যপ্রবাহ ছিল। ১৯৮০ সালে তা ১০ দিনে নেমে আসে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, ১৯৮৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ঢাকায় শৈত্যপ্রবাহ এসেছে প্রতি দুই বছরে একটি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যাপ্তি ছিল দুই থেকে তিন দিন। ২০১১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে শৈত্যপ্রবাহ আসার হার আরও কমে যায়। ব্যপ্তিও কমে যায়।

ঢাকা শহরের অপরিকল্পিত নগরায়ণ এখানকার সুন্দর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে ফেলেছে। যে কারণে এখানে শীতকালে শৈত্যপ্রবাহ আসে না। দেশের বিভিন্ন স্থানে বছরের বড় সময়জুড়ে রাতে হালকা ঠান্ডা পড়ে। ঢাকায় শীতকাল ছাড়া বাকি সময়জুড়ে দিন ও রাতে একই ধরনের উত্তাপ বা গরম অনুভূত হয়।
আশরাফ দেওয়ান, অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও জলবায়ু গবেষক

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক যুগে ঢাকায় বায়ুদূষণ পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। দূষণের কারণে ঢাকার ওপরে একটি ধুলা ও ধোয়াময় বাতাসের আবরণ তৈরি হয়। শীতকালে তা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। এই আবরণে বাঁধা পেয়ে শীতল বাতাস ঢাকায় প্রবেশ করতে পারে না। ফলে আশপাশে শৈত্যপ্রবাহ থাকলেও তা ঢাকায় প্রবেশ করতে পারে না।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, আগে দেশের উত্তরাঞ্চলসহ অন্যান্য জেলার সঙ্গে ঢাকার শীতের তাপমাত্রার খুব বেশি পার্থক্য দেখা যেত না। কিন্ত ঢাকায় দ্রুত নগরায়ণের কারণে শৈত্যপ্রবাহ কমে এসেছে।

উষ্ণতা বাড়লে ক্ষতি কী

২০২২ সালে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী রিসার্চ স্কয়ার–এ বাংলাদেশে গ্রীষ্ম ও শীতকালে তাপমাত্রার পরিবর্তন নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে দেখা যায়, ২০০১ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ঢাকায় গড় তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এ সময় রাজধানীর নগর এলাকা বেড়েছে ১৯ শতাংশ, জনসংখ্যা বেড়েছে ৭৬ শতাংশ। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জনশুমারি–২০২২–এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকায় জনসংখ্যা এখন ১ কোটি ২ লাখের বেশি।

জলাভূমি ও উন্মুক্ত স্থান রক্ষা এবং পরিকল্পিত নগরায়ণের জন্য ঢাকা মহানগর এলাকার জন্য বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) হয় ২০১০ সালে। এর আগে ১৯৯৫ সালে হয়েছিল ঢাকা মহানগর উন্নয়ন পরিকল্পনা। যদিও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) প্রভাবশালীদের চাপে কোনো পরিকল্পনাই ঠিকমতো বাস্তবায়ন করতে পারেনি। বাংলাদেশ ইনস্টিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) হিসাবে, ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ঢাকার ৩৬ শতাংশ জলাভূমি ভরাট হয়েছে।

এদিকে ২০২২ সালে ২০ বছর মেয়াদি নতুন ড্যাপের প্রজ্ঞাপন হয়েছে। সেটি নিয়ে প্রভাবশালীরা আপত্তি তুলছেন।

নগর উষ্ণ হয়ে যাওয়ার অর্থনৈতিক ক্ষতিও আছে। বাড়তি গরম শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের (এসি) ব্যবহার বাড়িয়ে দিচ্ছে। এটা আবার ভবনের বাইরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁরা এসি কিনে ব্যবহার করতে পারেন। যাদের সামর্থ্য নেই, তাঁরা গরমের ভুক্তভোগী বেশি হন। জীবাশ্ম জ্বালানির বাড়তি ব্যবহার পরিবেশ দূষণ বাড়ায়।

বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবে, দেশে গ্রীষ্মকালে বিদ্যুৎ দরকার হয় ১২ থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াট (দিনে সর্বোচ্চ)। ঢাকার চাহিদা থাকে তিন হাজার মেগাওয়াটের আশপাশে। শীতকালে তা অর্ধেকে নামে। কিন্তু তাপমাত্রা যত বেশি থাকে, বিদ্যুৎ তত বেশি লাগে।

বাংলাদেশকে এখন বিশ্ববাজার থেকে চড়া দামে জ্বালানি কিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হচ্ছে, যা বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের ওপর চাপ ফেলছে। সরকারও ভর্তুকি বেড়ে যাওয়ায় বারবার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়াচ্ছে। শীতকালেও লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, শীতকালেও ঢাকার তাপমাত্রা গ্রামের চেয়ে তিন থেকে চার ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি থাকায় বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। এটা অর্থনীতিতে চাপ বাড়াচ্ছে।