প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা অভিমুখী লংমার্চ পুলিশ লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার পর বিক্ষোভ করছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা। বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে লংমার্চ ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। এতে প্রায় অর্ধশত শিক্ষক–শিক্ষার্থী আহত হন। পরে পুলিশের হামলার বিচার ও তিন দফা দাবিতে কাকরাইল মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন তাঁরা। দাবি পূরণের স্পষ্ট ঘোষণা না আসা পর্যন্ত সেখানে অবস্থানের ঘোষণা দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসনব্যবস্থা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য আবাসন বৃত্তি ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে কার্যকর করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ বাজেট কাটছাঁট না করেই অনুমোদন করা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ পরবর্তী একনেক সভায় অনুমোদন করে অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়ন করার তিন দফা দাবিতে কিছুদিন ধরে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা।
গত মঙ্গলবার দুপুরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধিদল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) যায়। কিন্তু ইউজিসি থেকে আশানুরূপ কোনো ঘোষণা না আসায় ‘লংমার্চ টু যমুনা’ কর্মসূচি ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ‘জুলাই ঐক্য’ সংগঠনের পক্ষ থেকে এ কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়া হয়।
ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে বুধবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাত্তরের গণহত্যা ভাস্কর্য চত্বরের সামনে থেকে লংমার্চ শুরু করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল, ছাত্র অধিকার পরিষদ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্রশিবির, গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরাও অংশ নেন।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে লংমার্চ কাকরাইল মসজিদের সামনে পৌঁছালে বাধা দেয় পুলিশ। এ সময় আন্দোলনকারীরা পুলিশের দেওয়া ব্যারিকেড ভেঙে যমুনার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তখন পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করে। একপর্যায়ে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান ব্যবহার করে। এতে ছত্রভঙ্গ হয়ে আন্দোলনকারীরা পিছু হটেন। এ সময় প্রায় অর্ধশত শিক্ষক–শিক্ষার্থী আহত হন বলে আন্দোলনকারীরা জানান।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের নিবন্ধন সূত্রে জানা গেছে, অন্তত ৩৮ শিক্ষার্থী এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাঁদের প্রায় সবাই প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন। হাসপাতালে ভর্তি আছেন দুজন। তাঁরা হলেন ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী মাহতাব লিমন ও পরিসংখ্যান বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী সুবর্ণ আস সাইফ।
পরে বেলা দুইটার দিকে প্রায় ২০০ শিক্ষার্থী কাকরাইল মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। এতে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এ মোড় দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিকেলে চারটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আটটি বাসে এসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন কয়েক শ শিক্ষক–শিক্ষার্থী। তাঁদের মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম ও কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক সাবিনা শরমীন ছিলেন।
বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ওপর অতর্কিত হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আগে আন্দোলন বন্ধ করবেন না তাঁরা। হামলার অনুমতি দেওয়ায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনারের (এসি) বিচারের দাবিও জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক বলেন, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ হামলা চালিয়েছে। সহকারী প্রক্টরকে পুলিশ আঘাত করেছে। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য আন্দোলনে পুলিশ অমানবিক আচরণ করেছে। এর বিচার না হওয়া পর্যন্ত এখান থেকে যাওয়া হবে না।
বিক্ষোভকারীদের প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে যাওয়ার সুযোগ নেই বলে জানান ডিএমপির রমনা বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম। তিনি বলেন, এখানে ১৪৪ ধারা বহাল রয়েছে। আইন ভঙ্গ করলে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে
এদিকে বিকেল পাঁচটার দিকে উপাচার্যের নেতৃত্বে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় যায়। দাবিদাওয়ার বিষয়ে সরকারের অবস্থান জানাতে রাত ১০টার পরে অবস্থান কর্মসূচিতে আসেন তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম।
এ সময় মাহফুজ আলম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে দ্রুতই প্রধান উপদেষ্টা বৈঠক করবেন। বৈঠকে শিক্ষার্থীদের তিন দফা দাবির বিষয়ে সমাধানের চেষ্টা করা হবে। যেকোনো যৌক্তিক আন্দোলনের বিষয়ে সরকার কথা শুনবে।
তথ্য উপদেষ্টার বক্তব্যের শুরুতে ভুয়া ভুয়া স্লোগান দেওয়া হয়। পরে বক্তব্য চলাকালে ভিড় থেকে তথ্য উপদেষ্টাকে লক্ষ্য করে পানির বোতল নিক্ষেপ করা হলে তাঁর মাথায় লাগে। এরপর বক্তব্য বন্ধ করে তিনি ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
প্রায় ১৫ মিনিট পরে অবস্থান কর্মসূচি থেকে কিছুটা দূরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন মাহফুজ আলম। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একটি চক্র তাঁর ওপরে আক্রমণ করেছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে একটি পক্ষ ঢুকে স্যাবোটাজ (অন্তর্ঘাত) করার চেষ্টা করছে। যারা আমার ওপর হামলা করেছে, তারা জুলাই যোদ্ধাদের কেউ নন।’
রাত ১২টার পর আন্দোলনকারীদের পক্ষে কথা বলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সদস্যসচিব শামসুল আরেফিন। তথ্য উপদেষ্টার ওপর হামলার ঘটনায় তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। তবে এ ঘটনার দায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নেবে না বলে জানান।
এ সময় অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন শামসুল আরেফিন। তিনি বলেন, ‘উপদেষ্টা (মাহফুজ আলম) যে ব্রিফিং করেছেন, সেটি আরেকটি অস্পষ্টতা তৈরি করেছে। আমরা শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে এসেছি, সুস্পষ্ট ঘোষণা ছাড়া আমরা কোনোভাবেই এই জায়গা ছেড়ে যাব না।’