‘বাসা ছাইড়া দিসি, এখন টার্মিনালেই থাকতে হইব’

গাবতলী আন্তজেলা বাসটার্মিনালে বসে আছেন সিয়াম আহমেদ ও লাবণী আক্তার দম্পতি। ঢাকা, ৬ নভেম্বর
ছবি: ড্রিঞ্জা চাম্বুগং

তিনটি বস্তায় বিছানাপত্র, হাঁড়িপাতিলসহ সংসারের বিভিন্ন জিনিসপত্র। ছোট-বড় আরও দুটি ব্যাগে আছে কাপড়চোপড়। এ ছাড়া আছে একটি প্রেশার কুকার ও একটি টেলিভিশন।

ছোট একটি সংসারের মোটামুটি প্রায় সব জিনিসপত্র নিয়ে রাজধানীর গাবতলী আন্তজেলা বাসটার্মিনালে বাসের অপেক্ষায় বসে আছেন সিয়াম আহমেদ ও লাবণী আক্তার দম্পতি।

আজ সোমবার সকাল সোয়া নয়টার দিকে বাসটার্মিনালে কথা হয় এই দম্পতির সঙ্গে। অবরোধের মধ্যে তাঁরা রওনা হয়েছেন নড়াইল সদরের গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে। কিন্তু টার্মিনালে গিয়ে দেখেন, দূরপাল্লার বাস চলাচল করছে না। তারপরও তাঁরা টার্মিনালে বসে ছিলেন।

গাবতলী আন্তজেলা বাসটার্মিনাল, ঢাকা, ৬ নভেম্বর
ছবি: ড্রিঞ্জা চাম্বুগং

টার্মিনালে এভাবে বসে না থেকে ঢাকার বাসায় ফিরছেন না কেন, জানতে চাইলে সিয়াম বলেন, ‘বাসা তো ছাইড়া দিসি। এখন আর ফিরমু কই? বাস না ছাড়লেও এখন টার্মিনালেই থাকতে হইব। এ ছাড়া তো কোনো গতি নাই।’

সিয়াম একটি পণ্যবাহী ট্রাকে চালকের সহকারীর কাজ করেন। তাঁর স্ত্রী লাবণী গৃহিণী। রাজধানীর ঢাকা উদ্যান এলাকায় তাঁরা ভাড়া বাসায় থাকছিলেন। এখন তাঁরা গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়ে বিপদে পড়েছেন।

বিএনপিসহ বিরোধীদের ডাকা দ্বিতীয় দফার ৪৮ ঘণ্টা অবরোধের দ্বিতীয় দিন আজ। সকালে গাবতলী বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, এখান থেকে দূরপাল্লার কোনো গন্তব্যের বাস ছাড়ছে না। টার্মিনালে যাত্রী নেই বললেই চলে। বিভিন্ন বাস কোম্পানির টিকিট কাউন্টারগুলোও বন্ধ দেখা যায়।

গাবতলী আন্তজেলা বাসটার্মিনালে বসে আছেন এক যাত্রী। ঢাকা, ৬ নভেম্বর
ছবি: ড্রিঞ্জা চাম্বুগং

সিয়াম বলেন, তাঁরা সকাল আটটার দিকে টার্মিনালে এসেছেন। নড়াইল এক্সপ্রেস, দীগন্ত পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী এন আর পরিবহন, জননী এন্টারপ্রাইজসহ বিভিন্ন কাউন্টারে ঘুরেছেন। কিন্তু কেউ টিকিট বিক্রি করেনি। কাউন্টার থেকে বলা হয়, অবরোধের কারণে বাস বন্ধ রয়েছে। কেউ বলেছে, অবরোধ না বাড়লে বিকেলে বা রাতে বাস ছাড়তে পারে। কিন্তু অবরোধ বাড়লে বাস বন্ধই থাকবে। কেউ কেউ আবার বলেছে, রাতে বাস ছাড়বে।

প্রাইভেট কারে করে গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টাও করেছেন বলে জানান সিয়াম। তিনি বলেন, নড়াইল পর্যন্ত প্রাইভেট কারে ১০ হাজার টাকা চায়। এত ভাড়া দিয়ে তো যাওয়া সম্ভব নয়। তাই এখন অপেক্ষায় আছেন তাঁরা। বাস ছাড়লে বাড়ি যাবেন। তা না হলে টার্মিনালেই অপেক্ষা করবেন।

সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত এই টার্মিনালে ১১ যাত্রীকে আসতে দেখা যায়। এর মধ্যে বেশির ভাগ যাত্রী টিকিট না পেয়ে ফেরত গেছেন। আর টার্মিনালে অবস্থান করছিলেন সিয়াম-লাবণী দম্পতিসহ কয়েকজন যাত্রী।

গাবতলী আন্তজেলা বাসটার্মিনালের বাইরে প্রাইভেট কারের সারি। ঢাকা, ৬ নভেম্বর
ছবি: ড্রিঞ্জা চাম্বুগং

টার্মিনালে অবস্থান করা এক যাত্রী রংপুরের শহীদুর রহমান। তিনি ঢাকায় সদরঘাট এলাকার একটি কারখানায় কাজ করেন। শহীদুর জানান, মায়ের অসুস্থতার কারণে তাঁকে জরুরিভাবে বাড়ি যেতে হচ্ছে। কিন্তু টার্মিনালে এসে দেখেন, বাস বন্ধ। তাই বসে আছেন তিনি।

শহীদুর আরও বলেন, হানিফ ও শ্যামলী পরিবহনে যোগাযোগ করেছিলেন। তারা জানিয়েছে, অবরোধ না বাড়লে পরে বাস ছাড়বে। আর অবরোধ বাড়লে বাস বন্ধই থাকবে। যদি কোনো বাস ছাড়ে সেই আশায় তিনি সন্ধ্যা পর্যন্ত টার্মিনালে অপেক্ষা করবেন।

বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানির একাধিক প্রতিনিধি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা বাস ছাড়ার জন্য প্রস্তুত আছেন। কিন্তু বাস ছাড়ার মতো পর্যাপ্ত যাত্রী নেই।

সকাল ১০টার দিকে শ্যামলী এন আর পরিবহনের কাউন্টার ব্যবস্থাপক স্বপন চন্দ্র দাস প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত এই সময়ের মধ্যে কল্যাণপুর ও গাবতলী মিলিয়ে অন্তত সাতটি বাস ছেড়ে যেত। কিন্তু অবরোধের মধ্যে যাত্রী একেবারেই নেই। যাত্রী ছাড়া বাস ছাড়া সম্ভব নয়।

টার্মিনালের বাইরে প্রাইভেট কারের সারি দেখা যায়। জরুরি ভিত্তিতে যাঁদের গন্তব্যে যাওয়া প্রয়োজন, তাঁরা এসব প্রাইভেট কার ভাড়া করে যাচ্ছেন। কাছাকাছি গন্তব্যের তিন-চারজন যাত্রী মিলে প্রাইভেট কার চালকের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে দর–কষাকষি করতে দেখা যায়। কিন্তু চালকেরা ভাড়া চাচ্ছিলেন অনেক বেশি।

একটি প্রাইভেট কারের চালক আসলাম আলী বলেন, অবরোধের মধ্যে গাড়ি চালানো অনেক ঝুঁকির। মালিককে বেশি লাভ না দিলে গাড়ি বের করতে দেয় না। তাই ভাড়া বেশি নিতে হচ্ছে।