বিমানবন্দর-উত্তরা-দক্ষিণখান: জলাধার ভরাট, জলাবদ্ধতার শঙ্কা

রেলওয়ের নির্মাণ প্রকল্পের কাজে প্রাকৃতিক জলাধারটি ভরাট করা হয়েছে। ইতিমধ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

উন্নয়নকাজের জন্য রাজধানীর বিমানবন্দর রেলস্টেশনের পেছনের জলাধার ভরাট করে ফেলেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। গতকাল দুপুরে তোলাদীপু মালাকার

রাজধানীর বিমানবন্দর রেলস্টেশনের পেছনে (পূর্ব দিকে) একটি বড় জলাধার ছিল। সেখানে জমা হতো উত্তরার কয়েকটি সেক্টরসহ বিমানবন্দর ও দক্ষিণখান এলাকার বৃষ্টির পানি। সেই পানি বক্স কালভার্টের মাধ্যমে নামত এডি-৮ নামের একটি খালে। খিলক্ষেতের বনরূপা আবাসিক এলাকার পাশ দিয়ে খালটি বালু নদে গিয়ে মিশেছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ রেলওয়ের ‘ঢাকা-টঙ্গী সেকশনের তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েল গেজ লাইন (দ্বিতীয় সংশোধিত)’ নির্মাণ প্রকল্পের কাজে প্রাকৃতিক ওই জলাধার ভরাট করা হয়েছে। প্রকল্পটির অধীনে ওই অংশে ট্রেন চলাচলের জন্য আরও দুটি পথ (রেল ট্র্যাক) ও যাত্রী ওঠানামার প্ল্যাটফর্ম নির্মাণ করা হচ্ছে।

গত বুধবার সরেজমিনে দেখা যায়, জলাধারের কোনো অস্তিত্ব নেই। পুরো এলাকা বালু ফেলে ভরাট করা হয়ে গেছে। সেখানে রেলস্টেশন পর্যন্ত ভাড়ায় যাত্রী পরিবহনকারী কিছু প্রাইভেট কার পার্ক করে রাখতে দেখা গেছে।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রাকৃতিক এ জলাধার ভরাটের নেতিবাচক প্রভাব ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হলেই বিমানবন্দর ও উত্তরার কয়েকটি সেক্টরের জমে থাকছে পানি। সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতার।

আশঙ্কা করা হচ্ছে, দক্ষিণখান এলাকায় চলমান পয়োনিষ্কাশন নালার নির্মাণকাজ শেষে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। কারণ, দক্ষিণখানের অনেক এলাকার পানি ওই দিক দিয়েই নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ শুধু তাদের প্রকল্প নিয়ে ভাবছে। সিটি করপোরেশনকে ভাবতে হচ্ছে বাসিন্দাদের সমস্যা ও ভবিষ্যতে পানি অপসারণের ব্যবস্থা নিয়ে।
—খন্দকার মাহাবুব আলম, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পুর), ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন

ঢাকা উত্তর সিটির প্রকৌশলীরা আরও জানান, জলাধার ভরাট ছাড়াও আরেকটি সমস্যা রয়েছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ যে বক্স কালভার্টটি করছে, সেটি আকারে ছোট। ওই সব এলাকার পানি দ্রুত সময়ে নিষ্কাশনের জন্য এটি পর্যাপ্ত নয়।

অবশ্য রেলওয়ের ওই প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সিটি করপোরেশনের চাহিদা অনুযায়ী বক্স কালভার্টের আকার বড় করার বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে মৌখিক নির্দেশনা পাওয়া গেছে। দাপ্তরিক আদেশ পেলেই কাজটি শুরু করা হবে।

জলাবদ্ধতায় ভোগান্তি

দেশের বিভিন্ন স্থানে টানা ৩৫ দিন তাপপ্রবাহের পর গত ৫ মে সন্ধ্যায় রাজধানীতে বৃষ্টি হয়। এ বৃষ্টি ছিল ঢাকাবাসীর জন্য অনেকটাই স্বস্তির। আবহাওয়া অধিদপ্তরের রেকর্ড অনুযায়ী, সেদিন সন্ধ্যা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত রাজধানীতে ৩৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল।

কিন্তু এ বৃষ্টি স্বস্তির পাশাপাশি ভোগান্তি বয়ে আনে রাজধানীর উত্তরার ২ ও ৪ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দাদের জন্য। ঢাকা উত্তর সিটি সূত্রে জানা গেছে, সেদিনের বৃষ্টিতে উত্তরার ওই সেক্টরগুলোতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। দুর্ভোগে পড়েন বাসিন্দারা।

ঢাকা উত্তর সিটির কর্মকর্তারা বলছেন, বিমানবন্দর রেলস্টেশনের আশপাশের পানি স্টেশনের পেছনে থাকা ওই জলাধারে জমা হতো। উত্তরা ২ ও ৪ নম্বর সেক্টরের পানিও নালার মাধ্যমে সেখানে গিয়ে পড়ত। এ ছাড়া রেললাইন-সংলগ্ন পূর্ব দিকে দক্ষিণখানের প্রায় আড়াই কিলোমিটার এলাকার পানি ওই দিক দিয়েই নিষ্কাশনের পরিকল্পনা করে নালার নকশা করা হয়েছে।

জলাধারটি ভরাটের কারণে এখন মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হলেও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। ভবিষ্যতে এটি প্রকট আকার ধারণ করবে। এ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে কর্মকর্তারা বলছেন, যেহেতু ওই সব এলাকার পানিনিষ্কাশনের একমাত্র ভরসা এখন বক্স কালভার্ট, তাই কালভার্টটি অবশ্যই আকারে বড় করে নির্মাণ করতে হবে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পুর) খন্দকার মাহাবুব আলম প্রথম আলোকে বলেন, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ শুধু তাদের প্রকল্প নিয়ে ভাবছে। সিটি করপোরেশনকে ভাবতে হচ্ছে বাসিন্দাদের সমস্যা ও ভবিষ্যতে পানি অপসারণের ব্যবস্থা নিয়ে। এ বিষয়ে তারা সিটি করপোরেশনকে বিকল্প ব্যবস্থা করে নিতে বলেছে।

মাহাবুব আলম আরও বলেন, ওই অংশেই দ্রুতগতির উড়ালসড়কের (এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে) নির্মাণকাজও চলমান। সেখানেই হচ্ছে আশকোনা হজ ক্যাম্প থেকে বিমানবন্দরের দিকে একটি আন্ডারপাস। এখনই সঠিক পরিকল্পনা না নিলে অদূর ভবিষ্যতে ওই এলাকার পানি অপসারণ করা সম্ভব হবে না।

রেলমন্ত্রী ও মহাপরিচালককে চিঠি

জলাধার ভরাটের কারণে সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা হচ্ছে জানিয়ে রেলমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিমকে ১৩ জুন চিঠি দিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম। এর আগে গত ১৯ মে একই বিষয়ে রেলের মহাপরিচালক (ডিজি) সরদার সাহাদাত আলীকে চিঠি দেন ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম।

ওই দুটি চিঠিতে বলা হয়, সম্প্রতি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জলাশয় ভরাট করায় সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এর কারণ, বক্স কালভার্টের পূর্ব পাশের খালি জায়গা রেললাইন ও রেলস্টেশন প্ল্যাটফর্ম-৩ ও ৪ নির্মাণের জন্য ভরাট করা হয়েছে। পানি অপসারণের জন্য প্ল্যাটফর্ম ১ ও ২-এর নিচ দিয়ে ১ দশমিক ৮ মিটার আকারে ওই অংশে বক্স কালভার্ট বানানো হচ্ছে। পানি অপসারণের জন্য এবং ভবিষ্যৎ চাহিদা বিবেচনায় বক্স কালভার্টের প্রশস্ততা ন্যূনতম ৩ মিটার করা প্রয়োজন।

এ বিষয়ে মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই প্রকল্পের কারণে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। সেখানে এখন হাঁটুপানি জমে, ভবিষ্যতে জমবে মাথাসমান পানি। তখন জনগণ দুষবে সিটি করপোরেশনকে।

এ বিষয়ে মুঠোফোনে কথা হয় বাংলাদেশ রেলওয়ের ওই প্রকল্পের পরিচালক নাজনীন আরার সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের মন্ত্রী (রেলমন্ত্রী) নির্দেশ দিয়েছেন, মেয়রের চাহিদা অনুযায়ী বক্স কালভার্টের আকার ৩ মিটার করতে। লিখিত চিঠি পেলেই ওই অনুযায়ী কাজ করা হবে।’