ডেঙ্গু রোগী বাড়তে থাকায় মশকনিধনে তোড়জোড়

মশকনিধনে নেওয়া দুই সিটির কর্ম–পরিকল্পনার বড় অংশজুড়ে ছিল জনসচেতনতা তৈরি। রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যু বাড়লেও সে কাজে গতি নেই।

ডেঙ্গু আক্রান্ত এই শিশুর নাম মোহাম্মদ আলী। দুই দিন ধরে রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গতকাল দুপুরে
ছবি: সাজিদ হোসেন

এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে—স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এমন সতর্কবার্তা থাকলেও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে ঘাটতি ছিল। বছরের প্রথম ছয় মাসেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যু দুটোই যখন বেড়ে চলেছে, তখন দুই সিটি করপোরেশনের মশকনিধন কার্যক্রমে তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে।

গতকাল বুধবার থেকে ঢাকা উত্তর সিটি মশার উৎসস্থল শনাক্তে ড্রোন ব্যবহার শুরু করেছে। পাশাপাশি এ বছর প্রথমবারের মতো মশক নিয়ন্ত্রণে মাসব্যাপী বিশেষ চিরুনি অভিযান শুরু হচ্ছে ৮ জুলাই। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি গত মঙ্গলবার মশক নিয়ন্ত্রণে বিশেষ অভিযান শুরু করেছে।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনগণের সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা বাড়ানো জরুরি। অথচ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনেরই জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমে ঘাটতি রয়েছে। তাদের কার্যক্রম মূলত কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম আরও কয়েক গুণ বাড়াতে হবে বলে তাঁরা মনে করেন।

প্রতিকূল পরিবেশেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ হয়েছি। অন্যান্য দেশের তুলনায় এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুর অবস্থা ভালো। আমরা কার্যক্রম আরও বৃদ্ধি করছি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার আওতাধীন জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি বছরে তিনবার ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় মশা জরিপ করে। প্রাক্‌-বর্ষা, বর্ষা ও বর্ষা-পরবর্তী জরিপ। চলতি বছরের এপ্রিলে বর্ষা-পরবর্তী জরিপ করা হয়। তাতে ঢাকার কোনো কোনো এলাকার ১০ শতাংশ বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গিয়েছিল। তখনই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আশঙ্কা করে, এ বছর ডেঙ্গু রোগী বাড়তে পারে।

প্রতিবছরই ডেঙ্গু হচ্ছে, ভাবছি আগামী বছর হবে না। একটা সাময়িক ব্যবস্থা করে সন্তুষ্ট থাকছি। সিটি করপোরেশনের এত কম জনবল দিয়ে ডেঙ্গু মোকাবিলা করা যাবে না।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন

চলতি বছরের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৬২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছেন ১০ হাজার ৪৫৫ জন। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় (গত মঙ্গলবার সকাল আটটা থেকে গতকাল বুধবার সকাল আটটা পর্যন্ত) ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৮৪ জন। মারা গেছেন একজন। দেশে কোনো বছরের জুলাই মাসের শুরুতেই ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহ রূপ আর কখনো দেখা যায়নি।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবছরই ডেঙ্গু হচ্ছে, ভাবছি আগামী বছর হবে না। একটা সাময়িক ব্যবস্থা করে সন্তুষ্ট থাকছি। সিটি করপোরেশনের এত কম জনবল দিয়ে ডেঙ্গু মোকাবিলা করা যাবে না। সিটি করপোরেশনের লোকজন শুধু কীটনাশক প্রয়োগ করছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকারকে মূল উদ্যোগ নিতে হবে। তাতে ঘাটতি রয়েছে।’

প্রতিবেশী দেশের উদাহরণ দিয়ে এই জনস্বাস্থ্যবিদ বলেন, কলকাতা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে অনেকটাই সফল হয়েছে। দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ, স্থানীয় সরকার ও আন্তমন্ত্রণালয় কার্যক্রমে জোর দিতে হবে।

মোহাম্মদপুরের বায়তুল আমান হাউজিং, পিসি কালচার হাউজিং, নবোদয় হাউজিং, শ্যামলী হাউজিং, উত্তর আদাবর, ঢাকা হাউজিং, রফিক হাউজিং, মনসুরাবাদ, আদাবর ও শেখেরটেক এলাকা এই ওয়ার্ডের আওতাধীন।

জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো যায়নি

২০১৯ সালে দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের রেকর্ড ছাড়ায়। ওই বছরের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশকনিধনে বছরব্যাপী কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে। তাতে ডেঙ্গুর প্রাক্‌-মৌসুম (জানুয়ারি-মার্চ), মৌসুম (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) ও মৌসুম-পরবর্তী (অক্টোবর-ডিসেম্বর) কার্যক্রমের পরিকল্পনা ছিল। কর্মপরিকল্পনার বড় অংশজুড়ে ছিল জনসচেতনতা তৈরি।

দুই সিটি করপোরেশনই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ওয়ার্ড পর্যায়ে জনসচেতনতামূলক সভা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সভা, ওয়ার্ডভিত্তিক সচেতনতামূলক শোভাযাত্রা, ওয়ার্ডভিত্তিক মাইকিং, প্রচারপত্র বিতরণ ও গণপরিবহনে স্টিকার লাগানোর কার্যক্রম চালানোর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ডেঙ্গু রোগের বিষয়ে সতর্ক করা হলেও সচেতনতামূলক কার্যক্রমে গতি আসেনি।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমে ঘাটতির বিষয়টি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও উল্লেখ করেছেন। গত ১৫ জুন রাজধানীতে আয়োজিত এক সেমিনারে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ঘাটতি থাকার কথা বলেন। তিনি বলেন, হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন কাজ করছে। এখনো কাজের জায়গা রয়ে গেছে, ঘাটতি রয়ে গেছে।

গত মঙ্গলবার প্রকাশিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাক্‌-বর্ষা মশা জরিপের ফলাফলে ডেঙ্গু পরিস্থিতির উদ্বেগজনক চিত্র উঠে আসে। জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, ঢাকার দুই সিটির ৯৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫৫টিই উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।

অবশ্য ঢাকার দুই করপোরেশনের দাবি, তারা ডেঙ্গুর মৌসুম শুরুর আগে থেকেই জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছে। রোগী বাড়তে শুরু করার পর এসব কার্যক্রম আরও জোরালো করা হয়েছে।

ঢাকা উত্তর সিটির উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম মোস্তফা সারওয়ার বলেন, জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া সিটি করপোরেশনের পক্ষে ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব নয়। সিটি করপোরেশন যথেষ্ট চেষ্টা করছে মানুষকে সম্পৃক্ত করতে।

অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, ‘প্রতিকূল পরিবেশেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ হয়েছি। অন্যান্য দেশের তুলনায় এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুর অবস্থা ভালো। আমরা কার্যক্রম আরও বৃদ্ধি করছি।’ গতকাল হাতিরঝিলের পানিনিষ্কাশন যন্ত্র পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।

ড্রোন দিয়ে মশার উৎস খোঁজা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপে উত্তর সিটি করপোরেশনের যেসব ওয়ার্ড ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে তার মধ্যে ৩০ নম্বর ওয়ার্ড অন্যতম। মোহাম্মদপুরের বায়তুল আমান হাউজিং, পিসি কালচার হাউজিং, নবোদয় হাউজিং, শ্যামলী হাউজিং, উত্তর আদাবর, ঢাকা হাউজিং, রফিক হাউজিং, মনসুরাবাদ, আদাবর ও শেখেরটেক এলাকা এই ওয়ার্ডের আওতাধীন।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্তৃপক্ষ গতকাল এই ওয়ার্ডে ড্রোনের মাধ্যমে ভবনের ছাদে মশার উৎস চিহ্নিতকরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করে। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, পাঁচটি ড্রোনের মাধ্যমে সব ভবনের ছাদ পরীক্ষা করে দেখা হবে। ছাদে ও ছাদবাগানে জমা পানি থাকলে ম্যাজিস্ট্রেট ও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা গিয়ে পরিদর্শন করে দেখবেন লার্ভা আছে কি না।

রোগীর চাপ মুগদা হাসপাতালে

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গতকাল সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১ হাজার ৯১১ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এর মধ্যে ১ হাজার ২৮৫ জন ঢাকায় আর বাকিরা ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ভর্তি। রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি ৩৩১ জন রোগী ভর্তি ছিল মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। ডেঙ্গুতে এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চলতি বছর মারা গেছেন ২০ জন।

মুগদা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, জুনের শুরু থেকেই এই হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। রোগীদের বেশির ভাগই আসছেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, ধলপুর, শান্তিবাগ, কাজলা, মেরাদিয়া, মুগদা, বনশ্রীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে।

ডেঙ্গু রোগী বাড়লে আলাদা হাসপাতাল নির্ধারিত করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক আহমেদুল কবির। তিনি বলেন, প্রাক্‌-বর্ষা জরিপে ডেঙ্গু পরিস্থিতির ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জনগণকে সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম আরও চার-পাঁচ গুণ বাড়াতে হবে বলে তিনি মনে করেন।