ফাউন্টেনপেন, কালি ও দোয়াতের প্রদর্শনীতে ইতিহাসের রেখাপাত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সাহিত্যিকদের নামের সঙ্গে মিশে আছে ফাউন্টেনপেন বা ঝরনাকলমের নাম। ফাউন্টেনপেনে লিখেছেন আরও অনেক বিখ্যাত মানুষ। দোয়াত ও কালি দিয়ে লেখা হতো ফাউন্টেনপেনে। কিন্তু বলপয়েন্টের প্রচলনের পর ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে ফাউন্টেনপেন।
দেশের একদল সংগ্রাহক ফাউন্টেনপেনের ইতিহাসকে জাগরূক রাখতে চান। সেই চাওয়া থেকে তাঁরা হারিয়ে যাওয়া ফাউন্টেনপেন, দোয়াত ও কালির প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন রাজধানীর বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। এই আয়োজনে এসে অনেকেই ফিরে গেলেন এমন এক সময়ে, যা এখনকার আলোচনা থেকে হারিয়ে গেছে।
১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ফাউন্টেনপেন আবিষ্কার হয়েছিল। এরপর ধীরে ধীরে অন্যান্য দেশেও এর বহুল প্রসার ঘটতে থাকে। বাংলাদেশে ফাউন্টেনপেন এসেছিল ইংরেজদের হাত ধরে। এই কলমকে বাংলায় ‘ঝরনাকলম’ নামে নামকরণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নানা ধরন ও দামের ফাউন্টেনপেন বাজারে এসেছিল। পার্কার, শেফার্ড, ওয়াটারম্যান, সোয়ান ও পাইলটের ফাউন্টেনপেন এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এসব কলমে ছিল রকমারি ও টেকসই নিব ও হ্যান্ডেল। শৌখিন ও ধনী ব্যক্তিদের জন্য হীরা বসানো হতো কোনো কোনো কলমে। কখনো সোনা, প্লাটিনাম ইত্যাদি দিয়ে মুড়ে দেওয়া হতো ফাউন্টেনপেনকে।
বাংলাদেশ পেন ক্লাবের আয়োজনে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভবনে দুই দিনব্যাপী ‘ঢাকা পেন শো’র শেষ দিন ছিল শনিবার। প্রদর্শনীর পাশাপাশি এদিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে ক্যালিগ্রাফি বা অক্ষরশিল্প নিয়ে একটি কর্মশালারও আয়োজন করেছিল পেন ক্লাব।
গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে প্রদর্শনীতে গিয়ে দেখা গেল, ফাউন্টেনপেন, কালি ও দোয়াতের প্রদর্শনীতে ভিড় করেছেন সংগ্রাহক, শিক্ষার্থী ও উৎসুক অনেক দর্শনার্থী। পার্কার ও শেফারের মতো একসময়ের সুপরিচিত ব্র্যান্ডের ফাউন্টেনপেন ছিল প্রদর্শনীতে। ছিল এসব কলমের পুরোনো বিজ্ঞাপন, ক্রমবিকাশের সচিত্র বর্ণনাও। বহু পুরোনো দোয়াত ও কালি নিয়ে এসেছিলেন কোনো কোনো সংগ্রাহক। প্রদর্শনীতে ছিল আশির দশকের কর্ণফুলী কাগজসহ কিছু বিলুপ্ত কাগজের নমুনাও। ফাউন্টেনপেন ও কালি নিয়ে লেখা বিভিন্ন বই ও সাময়িকীও ছিল প্রদর্শনীতে।
প্রদর্শনীতে ফাউন্টেনপেন কেনারও সুযোগ ছিল। যেসব কাগজে ফাউন্টেনপেনের লেখা ভালো হয়, সে ধরনের কাগজের নোটবুকও বিক্রি করা হয় সেখানে। এই প্রদর্শনীর আয়োজক সংগঠন পেন ক্লাবের সদস্য হিসেবে থাকা বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের স্টলে ঘুরে ঘুরে পুরোনো কলম দেখেছেন, কিনেছেন দর্শনার্থীরা। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছিল সান ট্রেডিং হাউস, ফাইম’স কালেকশন, পেন বাজার বিডি ও সেভেন ডেইজ নোটস।
সান ট্রেডিং হাউসের একজন ষাটের দশকের একটি ফাউন্টেনপেন দেখিয়ে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘এর বয়স ৬৫ বছর।’
দোয়াত সংগ্রাহক
পেন ক্লাবের সদস্য হিসেবে থাকা কিছু প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যক্তিগত পর্যায়ের একজন সংগ্রাহককেও প্রদর্শনীতে অংশ নিতে দেখা যায়। তাঁদের একজন নাজমুল হক মন্টু। তিনি মূলত একজন দোয়াত সংগ্রাহক। প্রদর্শনীতে তিনি রৌপ্য, পিতল, তামা, দস্তা দিয়ে তৈরি দোয়াত যেমন নিয়ে এসেছিলেন, তেমনি তাঁর সংগ্রহে আছে বিশ শতকের শেষ ভাগের বিলুপ্ত পাতা কালি (গুঁড়া কালি), ট্যাবলেট কালি ও ক্যাপসুল কালি।
বিভিন্ন আকৃতির ক্রিস্টাল দোয়াত, সিরামিক হ্যান্ড আর্ট দোয়াত ও পাথর দোয়াত আছে নাজমুল হকের সংগ্রহে। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর কালির বোতল বা পাত্রের সংগ্রহও রয়েছে নাজমুল হকের। ১৮৯০ থেকে ১৯৮০ সালের কালির বোতলের সংগ্রহটি আলাদা করে চোখে পড়ছিল। এগুলোর মধ্যে ছিল পাইলট কালির বোতল (৩৫০ মিলিলিটার), ব্লুবার্ড কালির বোতল ও স্টনওয়্যার কালির বোতল।
এই সংগ্রাহক প্রথম আলোকে বললেন, ‘দোয়াত ও কলম জ্ঞানচর্চার সঙ্গে জড়িত। পৃথিবীতে অনেক কলম সংগ্রাহক থাকলেও দোয়াত সংগ্রাহক তেমন নেই। অথচ আগে দোয়াতই ছিল, কলম যেকোনো জিনিস দিয়ে তৈরি করা যেত। দোয়াতের ইতিহাস অন্তত পাঁচ হাজার বছরের। আমি মূলত অ্যান্টিক দোয়াত সংগ্রহ করি।’
আশির দশক পর্যন্ত ফাউন্টেনপেনে লিখতেন সংগ্রাহক নাজমুল হক। আশির দশকের শুরুর দিকে একটি দোকানে পিতলের পুরোনো একটি দোয়াত পেয়ে সেটি পাঁচ টাকা দিয়ে কিনেছিলেন। এর মাধ্যমেই তাঁর দোয়াত সংগ্রহ শুরু। তাঁর ভাষ্য, ‘তারপর একদিন দোয়াত পেলাম, যেটার মুখ না থাকলেও উল্টো করলেও কালি পড়বে না। তখন আমার মধ্যে একটা আগ্রহ জাগল। এটা ১৯৮৩ সালের কথা।’
মাটি ও কাচের তৈরি দোয়াত ও কালির পাত্রগুলো প্যাকেটে করে শোকেসে সংরক্ষণ করেছেন নাজমুল হক। তবে ধাতব বস্তু দিয়ে তৈরি অন্য দোয়াত ও কালির পাত্রগুলো সংরক্ষণ করতে তেমন বেগ পেতে হয়নি বলে তিনি জানান।
হাতে লেখা সংবিধান
বাংলাদেশের সংবিধান কীভাবে লেখা হয়েছিল, কোন কালি ব্যবহার করা হয়েছিল, কী কলম দিয়ে লেখা হয়েছিল—এসব তথ্য সংগ্রহ করেছে পেন ক্লাব। তারা বলছে, ১৯৭২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান লেখা হয়েছে ফাউন্টেনপেন দিয়ে। সংবিধানের চারপাশে যে শৈল্পিক নকশা ছিল, সেটিও আঁকা হয়েছিল ফাউন্টেনপেনে।
প্রদর্শনীতে সংবিধানের হাতে লেখা একটি কপি রাখা হয়েছিল। পেন ক্লাবের অন্যতম সংগঠক ইফতেখার হোসেইনের মতে, বাঙালি সংস্কৃতিপ্রবণ, কিন্তু ইতিহাসবিমুখ জাতি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ফাউন্টেনপেনকে আবার জনপ্রিয় করতে চান। সে জন্যই ফাউন্টেনপেন, দোয়াত ও কালি নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন।