‘ঐতিহ্য’ নিয়ে বিপাকে ২২০০ পরিবার

২২০০ বাড়ির তালিকা হলেও প্রকৃতপক্ষে ভবন পুনর্নির্মাণে অনুমোদন বন্ধ প্রায় ১০ হাজার বাড়ির। ভোগান্তির শিকার হাজারো মানুষ।

পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারে ২০০ থেকে ৩০০ বছরের পুরোনো বাড়ি আছে। সেসব বাড়িতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন বাসিন্দারা। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কারণে এসব বাড়ি সংস্কার করতে পারছেন না মালিকেরা। সম্প্রতি তোলা
ছবি: প্রথম আলো

পুরান ঢাকার নর্থব্রুক হল রোডের সাদামাটা একটি দ্বিতল বাড়ি। নিচতলায় খাবারের হোটেল, ওপরে টিনের ঘর। বাড়ির উত্তরাধিকারীরা বলছেন, এই ভবনের ঐতিহাসিক কোনো গুরুত্ব নেই, নান্দনিকতাতেও অনন্য নয়। কিন্তু এই বাড়িটি ঐতিহ্যবাহী ভবনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে আরবান স্টাডি গ্রুপ (ইউএসজি)। পুরান ঢাকার ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করা সংগঠনটির তালিকায় অন্তর্ভুক্তির কারণে ওই বাড়িটি ভেঙে নতুন বাড়ি নির্মাণের অনুমোদন দিচ্ছে না রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এমনকি বাড়িটি সংস্কারের অনুমোদনও পাচ্ছেন না এর মালিক।

ইউএসজির তালিকায় পুরান ঢাকায় ঐতিহ্যবাহী ভবন আছে ২ হাজার ২০০টি। তবে তালিকাটিতে শেষ পর্যন্ত ঐতিহ্যবাহী ভবন হিসেবে কতটি টিকবে, তা যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত করার দায়িত্ব প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের। কিন্তু চার বছরেও তালিকা চূড়ান্ত করতে পারেনি তারা।

যোগাযোগ করা হলে অন্তত ১০ জন ভবনমালিক ইউএসজির তালিকাটি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাঁদের অভিযোগ, ঢালাওভাবে তালিকাটি করা হয়েছে। এই তালিকার কারণে তাঁরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।

তবে ইউএসজির প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলাম বলছেন, সরেজমিন পরিদর্শন করে তাঁরা তালিকাটি করেছেন। তালিকায় ১ থেকে ২ শতাংশ ভুল হতে পারে। বাকিটা ঠিক আছে। পুরান ঢাকার ঐতিহ্য ও চরিত্র সংরক্ষণের উদ্দেশ্যেই তালিকাটি করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর দ্রুত কাজ শেষ করলে বাড়ির মালিকেরা এখনকার মতো সমস্যায় পড়তেন না।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, ২০১২ সালে ইউএসজির পক্ষ থেকে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাসংক্রান্ত একটি রিট পিটিশন আদালতে দাখিল করা হয়। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ওই তালিকায় থাকা ভবনগুলো যেখানে আছে, সেখানে নতুন করে ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদন না দিতে রাজউককে নির্দেশনা দেন আদালত। এতে রাজউকের ২ হাজার ২০০ ভবন যেসব স্থানে আছে, সেই স্থানগুলো সংস্থাটির নকশা অনুমোদনসংক্রান্ত সফটওয়্যারে ব্লক করে দেওয়া হয়। ফলে ওই তালিকায় থাকা কোনো ভবনের মালিক রাজউক থেকে ভবন নির্মাণের অনুমোদন নিতে গেলে আর অনুমোদন পান না।

আরও পড়ুন

ইউএসজির রিটের রায় হয় ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে। ওই রায়ে ইউএসজির তালিকাটি চূড়ান্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে। পাশাপাশি তিন মাস অন্তর এ কাজে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অগ্রগতি আদালতকে জানাতে বলা হয়। কিন্তু গত চার বছরে মাত্র ১০০টির মতো ভবন সম্পর্কে আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছে অধিদপ্তর।

অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রকাশনা) লাভলী ইয়াসমিন প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত তাঁরা আদালতে যে প্রতিবেদন দিয়েছেন, সেখানে একটি বা দুটি ভবন ছাড়া অন্য ভবনগুলোর ঐতিহাসিক বা নান্দনিক কোনো মূল্য নেই। আগামী ডিসেম্বর নাগাদ তালিকাটি চূড়ান্ত করা হবে।

অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ইউএসজির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে যেসব ভবনমালিক সংক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিকারের জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে গিয়েছিলেন, কেবল তাঁদের ভবন নিয়েই আদালতে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।

ইউএসজির উচিত ছিল সরকারের সঙ্গে মিলে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার তালিকা তৈরি করা। আর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উচিত ইউএসজির তালিকাটি যাচাই-বাছাই করে দ্রুত চূড়ান্ত করা। এখনো কেন সেটি করা গেল না, সে ব্যাপারে অধিদপ্তরকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
মোহাম্মদ ফজলে রেজা, সভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স

রাজউকের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউএসজির তালিকার কারণে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির বিষয়টি আমরাও অনুভব করছি। ২ হাজার ২০০ ভবন তো আর ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা হিসেবে থাকবে না, কমে আসবে। তালিকাটি যাতে দ্রুত চূড়ান্ত করা হয়, সে ব্যাপারে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে অনুরোধ করা হবে।

চূড়ান্ত তালিকার পর কী হবে

প্রত্নসম্পদ আইন (১৯৬৮) অনুযায়ী, ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব মূলত প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের। অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, মূলত মালিকানাবিহীন, পরিত্যক্ত বা সরকারি কোনো ঐতিহ্যবাদী স্থাপনা সংরক্ষণ বা রক্ষণাবেক্ষণ করে অধিদপ্তর। ব্যক্তিগত সম্পত্তি ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে বিবেচিত হলে সেটি সংরক্ষণের মতো জনবল ও বাজেট অধিদপ্তরের নেই। এমন অবস্থায় পুরান ঢাকার ২ হাজার ২০০ ভবনের তালিকাটি যাচাই-বাছাই করে যদি কয়েক শ ভবন চূড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকে, তবে সেটি রক্ষা করাও কঠিন হবে। কারণ, ঢাকায় জমির দাম ও ভবনের চাহিদার কারণে ব্যক্তিগত ভবনের মালিকেরা সেটি ভেঙে নতুন বহুতল ভবন করতে চাইবেন। কারণ, এতে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ বেশি।

এমন অবস্থায় কারও ব্যক্তিগত ভবন ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে বিবেচিত হলে কী করণীয়, জানতে চাইলে ইউএসজির প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডে উন্নয়ন স্বত্ব বিনিময়ের (টিডিআর) বিধান রয়েছে। ধরা যাক, ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা হিসেবে কারও তিনতলা বাড়ি সংরক্ষণ করতে হবে। কিন্তু তিনি সেখানে ১০তলা বাড়ি নির্মাণ করতে পারতেন। ফলে তিনি যে ৭টি তলা নির্মাণ করতে পারছেন না, ওই ৭তলার উন্নয়ন স্বত্ব তিনি অন্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করতে পারবেন। আর যিনি উন্নয়ন স্বত্ব কিনবেন, তিনি অন্য এলাকায় রাজউক অনুমোদিত ভবনের চেয়ে অতিরিক্ত সাততলা ভবন নির্মাণ করতে পারবেন। এভাবে আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া ভূমির মালিকানা মূল মালিকেরই থাকবে।

রাজউক ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এখনো টিডিআর–সংক্রান্ত কোনো বিধিমালা চূড়ান্ত করা হয়নি। এখন পর্যন্ত এমন সুবিধা কেউ নিয়েছেন বা দিয়েছেন, সে নজিরও নেই। আবার বিষয়টি নিয়ে ভবনমালিকদের মধ্যে আস্থার সংকটও রয়েছে।

এমন অবস্থায় বেসরকারি ঐতিহ্যবাহী ভবন রক্ষায় ভবনটি অধিগ্রহণ করা তুলনামূলকভাবে সহজ বিকল্প হতে পারে বলে মনে করেন রাজউকের কর্মকর্তারা। প্রত্নসম্পদ আইনে সেই সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা ঐতিহাসিক ‘রোজ গার্ডেন’র উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, ভবনটি ব্যক্তিমালিকানাধীন ছিল। এই ভবনেই ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরে আওয়ামী লীগ) গঠন করা হয়। ১৯৮৯ ভবনটিকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষিত ভবন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছিল। পরে ২০১৮ সালে ৩৩১ কোটি ৭০ লাখ টাকায় বাড়িটি কিনে নেয় সরকার।

ভোগান্তি তালিকার চেয়েও বেশি

ইউএসজির তালিকায় ২ হাজার ২০০ ভবন অন্তর্ভুক্ত হলেও রাজউক থেকে ভবন নির্মাণের ছাড়পত্র পাচ্ছে না, এমন ভবনের সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। পুরান ঢাকা রাজউকের অঞ্চল-৭–এর আওতাধীন। এই জোনের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইউএসজির তালিকাটি করা হয়েছে হোল্ডিং নম্বর ও আরএস দাগ নম্বর ধরে। ফলে একটি দাগে থাকা একাধিক বাড়ি ওই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এতে তালিকায় মোট বাড়ির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ হাজার। অর্থাৎ ওই তালিকার কারণে অন্তত ১০ হাজার বাড়ির সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ আটকে আছে।

ভুক্তভোগী একজন নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, সূত্রাপুর মৌজার একটি দাগে তিনটি ভবন আছে। এর মধ্যে একটি ভবন ইউএসজির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত আছে। কিন্তু রাজউক থেকে পুরো দাগ নম্বরটি ব্লক করে রাখায় অন্য বাড়িগুলো ভেঙে ভবন নির্মাণের অনুমোদন পাওয়া যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন

দায় নেয় না কেউ

ইউএসজির তালিকা ছাড়াও বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার আরও দুটি তালিকা আছে। রাজউকের তৈরি করা তালিকায় আছে ৭৪টি ভবন এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকায় আছে ১০৬টি পুরাকীর্তি। এগুলো সংরক্ষণের দায়িত্ব কার, জানতে চাইলে রাজউকের নগর–পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকা অনুযায়ী পুরাকীর্তিগুলো দেখভালের দায়িত্ব ওই অধিদপ্তরের। রাজউকের তালিকা অনুযায়ী ভবনগুলো দেখভালের দায়িত্ব রাজউকের। সিটি করপোরেশন আইন অনুযায়ী, জরাজীর্ণ কোনো ভবন সিটি করপোরেশন সংরক্ষণ করতে পারে। এ ছাড়া ঐতিহাসিক স্থাপনা রক্ষায় টিডিআরের যে বিধান রয়েছে, সেটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব রাজউকের।

দায়িত্ব থাকলেও তার যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। প্রত্নসম্পদ আইন অনুযায়ী, সরকার চাইলে বেসরকারি কোনো ঐতিহাসিক ভবন অধিগ্রহণ, মালিকানা না পেলে ভবন নিজের জিম্মায় নেওয়া এবং কোনো ভবনমালিক ভবন সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে মালিকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার সেই ভবনের অভিভাবকত্ব নিতে পারে।

কিন্তু রাজউকের তালিকায় থাকা দেওয়ানবাড়ী কমপ্লেক্স ও মসজিদের উত্তরাধিকার দাবিদার একজন বলেছেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা হিসেবে ঘোষণা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করা হয়। কিন্তু দেখভালের দায়িত্ব কেউ নেয় না। তিনি বলেন, দেওয়ানবাড়ী কমপ্লেক্সটি দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কমপ্লেক্সের সামনের পুকুরের একাংশ ভরাট করা হয়েছে। কমপ্লেক্সটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ও রাজউকে একাধিক চিঠি দেওয়া হলেও কেউ দায়িত্ব নেয়নি।

সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন প্রথম আলোকে বলেন, ইউএসজির উচিত ছিল সরকারের সঙ্গে মিলে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার তালিকা তৈরি করা। আর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উচিত ইউএসজির তালিকাটি যাচাই-বাছাই করে দ্রুত চূড়ান্ত করা। এখনো কেন সেটি করা গেল না, সে ব্যাপারে অধিদপ্তরকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। অন্যদিকে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সংরক্ষণে কে কোন দায়িত্ব পালন করবে, এ–সংক্রান্ত অস্পষ্টতা দূর করে সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। শুধু ঘোষণা দিয়ে ফেলে রাখলেই হবে না।