পয়োনালার পানিতে বন্ধ হওয়ার পথে ঢাকার দক্ষিণখানের বিদ্যালয়টি

চালাবন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০২২ সালে শিক্ষার্থী ছিল ৪৭২ জন। এ বছর কমে দাঁড়িয়েছে ১২৩ জনে।

রাজধানীর উত্তরার দক্ষিণখানে চালাবন্দ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের সড়ক ও মাঠে বছরজুড়ে থাকে জলাবদ্ধতা। বৃষ্টি হলে পানি ঢুকে যায় বিদ্যালয়ের নিচতলার কক্ষগুলোতেও। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়। গতকাল দুপুরে বিদ্যালয়ের সামনেছবি: সাজিদ হোসেন

বিদ্যালয়ের সামনের সড়কে জমে আছে পয়োনালার পানি। বিদ্যালয়ের মাঠের বেশির ভাগ জায়গা ডুবে আছে ওই নোংরা পানিতে। নিচতলার দুটি শ্রেণিকক্ষের ভেতরে, বারান্দায়, শৌচাগারে যাওয়ার পথে, এমনকি শৌচাগারেও পয়োনালার পানি।

এ চিত্র রাজধানীর দক্ষিণখানের চালাবন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি এখন শিক্ষার্থীসংকটে ভুগছে। কারণ হিসেবে পয়োনালার নোংরা পানিতে বছরজুড়ে থাকা জলাবদ্ধতাকে দুষছেন বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা।

শিক্ষকেরা বলছেন, নোংরা পানির কারণে বিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে না। অনেক অভিভাবকে সন্তানদের এখান থেকে নিয়ে অন্যত্র ভর্তি করাচ্ছেন। আর যে শিক্ষার্থীরা এখনো আছে, তারাও নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসছে না।

বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাইমন আহমেদ প্রথম আলোকে বলে, ‘নোংরা পানির জন্য স্কুলে যাইতে খারাপ লাগে। স্কুলে যাইতেও ইচ্ছে করে না।’ তার কয়েকজন বন্ধু এ বছর স্কুলে ছেড়ে দিয়েছে বলে সে জানায়।

ছেলেকে স্কুলে একা পাঠাতে ভয় করে। রাস্তা, মাঠ ও টয়লেট— সবখানেই পানি। তা–ও আবার নোংরা। তাই নিজে সপ্তাহে দু-একদিন কোলে করে ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যাই।
রত্না আক্তার, অভিভাবক

বিদ্যালয় ছাড়ছে শিক্ষার্থীরা

বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ওই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৫১১। পরের বছরগুলোয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে। ২০২২ সালে বিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থী কমে দাঁড়ায় ৪৭২ জনে। ২০২৩ সালে সে সংখ্যা অর্ধেকের বেশি কমে, এটি হয় ১৭৭। চলতি বছর ১২৩ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।

গতকাল সোমবার দুপুরে বিদ্যালয়টিতে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের সামনের সড়কে (মাটির মসজিদ সড়ক) জমে আছে প্রায় হাঁটুসমান পানি। সেই পানি থেকে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ, ভাসছে ময়লা-আবর্জনা। এই পানি মাড়িয়েই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে যেতে হচ্ছে।

বিদ্যালয়ের নিচতলায় তিনটি কক্ষ।  নিচতলার শ্রেণিকক্ষ দুটির দরজা গতকাল বন্ধ ছিল। ভেতরে জমে ছিল নোংরা পানি। শিক্ষকেরা জানান, পানি সেচলেও আবার মেঝে থেকে পানি উঠে আসে। তাই গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ওই কক্ষগুলোয় পাঠদান বন্ধ রয়েছে। দোতলার তিনটি কক্ষে এখন পাঠদান করা হচ্ছে।

শিক্ষক কামরুন নাহার প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিদিন এই নোংরা পানি মাড়িয়ে আসতে হয়। বাসা থেকে বোতলে পানি নিয়ে আসি। স্কুলে ঢুকে ওই পানি দিয়ে কোনোমতে পা ধুয়ে নিই।’

শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি অনিয়মিত

চালাবন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে ১২৩ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এর মধ্যে ৪৭ জন ছাত্র আর ৭৬ জন ছাত্রী। কিন্তু নোংরা পানির কারণে ওই শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই বিদ্যালয়ে নিয়মিত আসে না। গতকাল ওই বিদ্যালয়ে অর্ধেকেরও কম শিক্ষার্থী (৬০ জন) উপস্থিত ছিল। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণির ২৩ জন; ১৯ জনই ছিল অনুপস্থিত।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সারওয়ার জাহান প্রথম আলোকে বলেন, গত তিন বছরে এক দিনের জন্যও সামনের সড়কটি শুকনা ছিল না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে একাধিকবার সভা হলেও কোনো সুরাহা হচ্ছে না।

চলতি বছরের গত পাঁচ মাসে পর্যায়ক্রমে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হারও কমছে। গত জানুয়ারিতে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার ছিল ৭৭ শতাংশ। কিন্তু মে মাসে কমে অর্ধেকে নেমে আসে।

বিদ্যালয়ের কাছেই ঢাকা উত্তর সিটির সংরক্ষিত নারী আসনের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইলোরা পারভীনের বাসা। তিনি বলেন, ওই এলাকায় নালা ও সড়ক মেরামতের জন্য অর্থ বরাদ্দ হলেও কাজ শুরু হচ্ছে না।

গাওয়াইর এলাকার কাজীবাড়ি সড়কের বাসিন্দা রত্না আক্তার ছোটখাটো ব্যবসা করেন। তাঁর ছেলে রিফাত আল রাফি এই বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। রত্না প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলেকে স্কুলে একা পাঠাতে ভয় করে। রাস্তা, মাঠ ও টয়লেট— সবখানেই পানি। তা–ও আবার নোংরা। তাই নিজে সপ্তাহে দু-একদিন কোলে করে ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যাই।’