যুক্তি–পাল্টাযুক্তিতে প্রাণবন্ত বিতর্ক উৎসব

‘যোগ দাও যুক্তির মেলায়’ স্লোগান নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো শুরু হলো পুষ্টি-প্রথম আলো স্কুল বিতর্ক উৎসব। সারা দেশে বিতর্কচর্চা ছড়িয়ে দিতে এবার ৪০টি আঞ্চলিক উৎসব অনুষ্ঠিত হবে

পুষ্টি-প্রথম আলো স্কুল বিতর্ক উৎসবের উদ্বোধন হয়ে গেল মোহাম্মদপুরে সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। ঢাকা, ২৭ মেছবি: প্রথম আলো

এক পক্ষের যুক্তি, এই সময়ে মেধাবী মানুষের চেয়ে মানবিক মানুষ বেশি দরকার। কারণ, দুর্নীতি করে মেধাবীরা। আবার বিদেশে পাড়ি জমায় মেধাবীরাই। অন্যদিকে বিদেশে গেলেও প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) পাঠান মানবিক মানুষগুলোই। তাই মেধার সঙ্গে মানবিকতার সমন্বয় দরকার।

অন্য পক্ষের যুক্তি, মেধাবী মানুষ হওয়াটা বেশি দরকার। যেমন করোনা মহামারির সময়ে মেধাবী বিজ্ঞানীরাই টিকা আবিষ্কার করেছেন। এভাবে অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাঁরা দরকারি ভূমিকা পালন করছেন। আর মেধার সঙ্গে মানবিকতার বিরোধ নেই।

এমন যুক্তি ও পাল্টাযুক্তির প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছিল ঢাকার বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আজ শনিবার রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পুষ্টি-প্রথম আলো স্কুল বিতর্ক উৎসবের উদ্বোধনী দিনে এই প্রদর্শনী বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। যুক্তি-পাল্টাযুক্তির এই খেলায় পুরো অনুষ্ঠান প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। দর্শকসারিতে বসা অসংখ্য ছাত্রছাত্রীও এসব যুক্তি শুনে হাততালি দিচ্ছিলেন।

‘যোগ দাও যুক্তির মেলায়’ স্লোগান নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো প্রথম আলোর আয়োজনে এই বিতর্ক উৎসবে এ বছরও পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছে টিকে গ্রুপের ব্র্যান্ড পুষ্টি। সহযোগিতায় প্রথম আলো বন্ধুসভা এবং প্রচার সহযোগী হিসেবে আছে নাগরিক টিভি।

সারা দেশে বিতর্কচর্চা ছড়িয়ে দিতে এবার ৪০টি আঞ্চলিক উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। শিগগিরই সারা দেশের আঞ্চলিক বিতর্ক উৎসবের তারিখ প্রথম আলো পত্রিকার মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হবে। প্রতিটি অঞ্চলের সেরা বিতার্কিকদের নিয়ে হবে চূড়ান্ত পর্বের প্রতিযোগিতা।

আজ সকাল সাড়ে নয়টায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হলেও তার বেশ আগে থেকেই সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এসে হাজির হতে থাকেন রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা। লাইন ধরে নিবন্ধন করতে দেখা যায় তাদের। সেখানে কথা হয় আল আরাফাত হোসেনের সঙ্গে। সে রাজধানীর রায়েরবাজার হাইস্কুলে পড়ে। সকালে বিদ্যালয়ে গিয়ে, সেখান থেকে শিক্ষকের সঙ্গে এই অনুষ্ঠানে এসেছে আরাফাত। তার মতে, বিতর্কের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়।

জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে বিতর্ক উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয়। এ সময় সবাই দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানান। ঢাকা, ২৭ মে
ছবি: প্রথম আলো

নিবন্ধন শেষে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন অভিনয়শিল্পী চঞ্চল চৌধুরী ও ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিজ ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২২ শিরোপাজয়ী সৌরদীপ পাল।

চঞ্চল চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের পুরো জাতি এখন চলে গেছে যুক্তির বাইরে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পথচলা থেকে শুরু করে কথাবার্তা, পারিবারিক সম্পর্কগুলো অধিকাংশ জায়গায় যুক্তির ধার ধারে না। আমরা শুধু তর্ক করে যাই, নিজের মতামতকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করি। আমরা যুক্তি মানি না। সহজ ভাষায় আজাইরা তর্ক, এখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।’

শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে এই অভিনেতা বলেন, পড়াশোনার পাশাপাশি প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বাড়তি কিছু শেখা ও চর্চা করতে হবে। যৌক্তিক ও মানবিক মানুষ হতে হবে। সমাজের জন্য ও দেশের জন্য ভালো কিছু করতে হবে।

বক্তব্য শেষে সাম্প্রতিক আলোচিত গান ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গেয়ে শোনান চঞ্চল চৌধুরী।
সৌরদীপ পাল মনে করেন, বিতর্ক কেবল যুক্তি নয়, জ্ঞানেরও লড়াই। এ জন্য তিনি শিক্ষার্থীদের জ্ঞান আহরণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

টেন মিনিট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আয়মান সাদিকও এসেছিলেন শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দিতে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে শোনাও যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেটি তুলে ধরেন তিনি। একই সঙ্গে মনোযোগ দিয়ে কীভাবে শোনা যায়, তারও কৌশল দেখান।

বিতর্ক করতে হলে অনেক পড়তে হবে বলে মনে করেন সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ব্রাদার লিও পেরেরা।

কিশোর বয়সীরা কীভাবে মাদকে জড়ায়, তার প্রতি ইঙ্গিত করে মনোরোগ চিকিৎসক আহমেদ হেলাল বলেন, কিছু বন্ধু প্রথমে ‘সুখটান’ দেওয়ার কথা বলে। তাই এটিকে ‘না’ করতে হবে।

আমরা শুধু তর্ক করে যাই, নিজের মতামতকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করি। আমরা যুক্তি মানি না। সহজ ভাষায় আজাইরা তর্ক, এখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে
চঞ্চল চৌধুরী, অভিনেতা

পুষ্টি কনজ্যুমার বিভাগের বিজনেস প্রধান আলম চৌধুরী জীবনচলার পথে মিথ্যা কথা না বলা এবং অজুহাত না দেখানোর পরামর্শ দেন।

প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, ‘মনে হচ্ছে এখন নীতিনৈতিকতায় অবনতি ঘটেছে। পড়াশোনার পাশাপাশি তোমরা যখন গান করবে, বিতর্ক করবে, জ্ঞানের জগতে ঢুকবে, বই পড়বে; তখন দেখবে ছাঁচের বাইরেও পৃথিবীতে একটি বিরাট মানবজগৎ আছে, যা তোমাদের সামনের পৃথিবীতে চলতে শেখাবে। বিতর্ক করতে হবে ভালো মানুষ হওয়ার জন্য, গান গাইতে হবে ভালো মানুষ হওয়ার জন্য। তোমাদের ভালো মানুষ হওয়ার দিকে আহ্বান জানাই।’

বিতর্ক উৎসবে অনুষ্ঠানে অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সমাজের জন্য ও দেশের জন্য ভালো কিছু করতে হবে। ঢাকা, ২৭ মে
ছবি: প্রথম আলো

টিকে গ্রুপের হেড অব ব্র্যান্ড অ্যান্ড কমিউনিকেশন মো. ইব্রাহিম খলিল বলেন, পুষ্টি টিকে গ্রুপের এমন একটি ব্র্যান্ড, যেটি শুধু ভোগ্যপণ্য উৎপাদন ও বিপণন করে না। পাশাপাশি দেশের মানুষের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্যও কাজ করে। তারই ধারাবাহিকতায় এই বিতর্ক উৎসব আয়োজনে পাশে আছে পুষ্টি।
সফলতার জন্য সংকল্প থাকতে হবে বলে মনে করেন টিকে ফুড প্রোডাক্টস ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের হেড অব সেলস নাজমুল হোসাইন।

শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দিতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস-এর এ বছরের ‘থার্টি আন্ডার থার্টি’-তে স্থান করে নেওয়া বাংলাদেশের তরুণ টার্টল ভেঞ্চার স্টুডিওর প্রতিষ্ঠাতা সারাবন তাহুরা, আনোয়ার সায়েফ প্রমুখ।

কিশোর বয়সীরা কীভাবে মাদকে জড়ায়, তার প্রতি ইঙ্গিত করে মনোরোগ চিকিৎসক আহমেদ হেলাল বলেন, কিছু বন্ধু প্রথমে ‘সুখটান’ দেওয়ার কথা বলে। তাই এটিকে ‘না’ করতে হবে।

অনুষ্ঠানে সাফ নারী ফুটবল বিজয়ীদের নিয়ে প্রথম আলোর তৈরি করা ভিডিও ‘সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে’ দেখানো হয়। এ ছাড়া ‘জন্ম আমার ধন্য হলো’ ও ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ গান দুটি গেয়ে শোনান গত ফেব্রুয়ারিতে প্রথম আলোর উদ্যোগে আয়োজিত বর্ণমালা অনুষ্ঠানে সেরা হওয়া কয়েকজন শিল্পী।

বিতর্ক নিয়ে কর্মশালা

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছিল বিতর্ক নিয়ে কর্মশালা। সেখানে শিক্ষার্থীরা জানতে চায় বিতর্কের নানা কলাকৌশল। সেগুলোর উত্তর দেন টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব ও বাংলাদেশ ডিবেট ফেডারেশনের (বিডিএফ) সাবেক সভাপতি আব্দুন নূর তুষার, বন্ধুসভার সভাপতি উত্তম রায়, সাধারণ সম্পাদক জাফর সাদিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাওহিদা জাহান, সংবাদ পাঠক রোমানা শারমীনসহ কয়েকজন।

আব্দুন নূর তুষার বলেন, সঠিক থাকলে সাহস করে যা ঠিক, সেটা জোরে বলতে হবে। যে সমাজে কথা বলা হয় না, সেই সমাজ বদলায় না।

এ সময় দর্শকসারিতে থাকা শিক্ষার্থীরাও নিজেদের অনুভূতি জানায়। তাদেরই একজন মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী মুসফিকা জাহান বলল, জানার জন্য এই অনুষ্ঠান বড় এক সুযোগ। তাই তার অনুরোধ, এ ধরনের অনুষ্ঠান যেন আরও করা হয়।

শেষে অনুষ্ঠিত হয় প্রদর্শনী বিতর্ক। যার বিষয় ছিল ‘এই সময়ে মেধাবী মানুষের চেয়ে মানবিক মানুষ বেশি দরকার’। এই বিতর্কের পক্ষ দলের নেতৃত্ব দেয় আলিফ হোসেন এবং বিপক্ষ দলে নেতৃত্ব দেয় ওয়াশিকা আয়াস। এই পর্বে মডারেটরের দায়িত্ব পালন করেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন। এতে বিচারকের দায়িত্বে ছিলেন বাংলাদেশ ডিবেট ফেডারেশনের সভাপতি আবদুল্লাহ আহমেদ শুকরানা ও ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার উপদেষ্টা ফাল্গুনী মজুমদার প্রমুখ।

পুরো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো বন্ধুসভার নির্বাহী সভাপতি মৌসুমি মৌ। বিতর্ক উৎসবের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন সাইদুজ্জামান রওশন। উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলোর ইভেন্ট অ্যান্ড অ্যাকটিভেশন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক অরূপ কুমার ঘোষ এবং হেড অব কালাচারাল প্রোগ্রাম কবির বকুল।