ওয়ার্ডে ছিল সন্তান ও স্ত্রী, ভিড় ঠেলে যেতে পারছিলাম না: ইব্রাহিম

সন্তানকে কোলে নিয়ে ইব্রাহিম হোসেনছবি: প্রথম আলো

আজ শুক্রবার সকালে ২১ দিন বয়সী সন্তান আবদুল্লাহ আল ইমতিয়াজকে ঢাকার শিশু হাসপাতালে ভর্তি করেন ইব্রাহিম হোসেন ও পান্না আক্তার দম্পতি। হাসপাতালের বি-ব্লকের চতুর্থ তলার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে তার ঠাঁই হয়। শিশুটি ঠান্ডা ও শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগছে।

দুপুরে জুমার নামাজ পড়ার জন্য স্ত্রী-সন্তানকে ওয়ার্ডে রেখে নিচে গিয়েছিলেন ইব্রাহিম। নামাজ শেষে লোকজনের কাছে শুনতে পান হাসপাতালে আগুন লেগেছে। এরপর দ্রুত দৌড়ে হাসপাতালে পৌঁছান। দেখেন অনেক মানুষ হুড়োহুড়ি করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছেন। এর মধ্য দিয়েই অনেক কষ্টে তিনি ভিড় ঠেলে চতুর্থ তলায় যান। ততক্ষণে ধোঁয়া ও পোড়া গন্ধ ওই তলায়ও ছড়িয়ে পড়েছে।

লক্ষ্মীপুর থেকে আজ সকালে ঢাকায় আসেন তাঁরা। ইব্রাহিম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগুনের খবর শুইনা হাত-পা কাঁপছিল। আল্লাহর কাছে শুধু চাইছিলাম, আমার স্ত্রী আর ছেলের যাতে কিছু না হয়। ওপরে গিয়ে দেখি আমার স্ত্রী ছেলেকে কোলে নিয়ে ব্যাগ হাতে সিঁড়ির কাছে চলে আসছে। আমি দ্রুত ছেলেকে কোলে নিই। স্ত্রীকে সঙ্গে করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসি।’ তিনি যখন স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে নিচে নামেন, তখনো ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সেখানে পৌঁছাননি বলে তিনি দাবি করেন।

আজ বেলা সোয়া তিনটার দিকে কথা হয় ইব্রাহিম-পান্না দম্পতির সঙ্গে। তখন এই দম্পতি হাসপাতালের এ-ব্লকের নিচতলার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ইব্রাহিমের কোলে ছিল ছেলে। আর স্ত্রী পান্না হাসপাতালের ব্যবস্থাপত্রের কাগজ দিয়ে সন্তানকে বাতাস করছিলেন।

আজ দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক আইসিইউ বিভাগে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে জানানো হয়, বেলা ১টা ৩৫ মিনিটের দিকে তাঁরা আগুন লাগার খবর পান। বেলা ২টা ৪০ মিনিটের দিকে আগুন নেভানো হয়। আগুনের সময় আইসিইউতে ৭ জন এবং বিভিন্ন ওয়ার্ড ও কেবিনে মোট ১৭৩ জন রোগী ভর্তি ছিল।

আগুন লাগার ঘটনায় হাসপাতালে থাকা রোগীর স্বজনদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। যে যেভাবে পেরেছেন নিচে নেমে এসেছেন। অনেকে শিশু হাসপাতালের কর্মীদের আবাসনের (স্টাফ কোয়ার্টারের) সামনে, আবার কেউ কেউ হাসপাতালের এ-ব্লকের নিচে বসে, দাঁড়িয়ে থাকেন।

এ সময় প্রচণ্ড গরমের মধ্যে শিশুরা (রোগী) কান্নাকাটি করছিল। সন্তানকে শান্ত করতে অভিভাবকেরা কেউ ব্যবস্থাপত্রের ফাইলের কাগজ দিয়ে, কেউবা আবার জামাকাপড় দিয়ে সন্তানকে বাতাস করছিলেন।

স্টাফ কোয়ার্টারের সামনে ছায়ায় সাড়ে তিন মাস বয়সী কন্যা ফাতেমাকে কোলে নিয়ে বসে ছিলেন ইউসুফ আলী। পাশ থেকে স্ত্রী মাহি আক্তার সন্তানকে বাতাস দিচ্ছিলেন। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ফাতেমাকে ঈদুল ফিতরের দুদিন আগে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সে ছিল বি-ব্লকের নিচতলার ৯ নম্বর ওয়ার্ডে।

বেলা একটার দিকে স্ত্রী ও শ্যালিকার জন্য খাবার আনতে এবং নিজে খেতে বাইরে গিয়েছিলেন ইউসুফ আলী। সেখানে লোকজনের মুখে শোনেন হাসপাতালে আগুন লেগেছে। দ্রুত ছুটে আসেন হাসপাতালে। মানুষের চাপে ঢুকতেই পারছিলেন না। প্রায় ৫ মিনিট অপেক্ষার পর ভিড় ঠেলে ভেতরের দিকে যান তিনি। দ্রুত স্ত্রী, সন্তান ও শ্যালিকাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন।

আরও পড়ুন

আগুন লাগার সময়ের বর্ণনা দিয়ে ইউসুফের স্ত্রী মাহি আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবুর স্যালাইন চলছিল। আমি বাবুকে নিয়ে ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ মানুষের চিৎকার–চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে যায়। দেখি সবাই বাচ্চাকাচ্চা কোলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। তখন আগুনে পোড়ার গন্ধ পাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাবুর স্যালাইন খোলার জন্য প্রথমেই আমি নার্সদের খুঁজি। কিন্তু ততক্ষণে নার্সরা সবাই বেরিয়ে চলে গেছেন। পরে পাশের ৮ নম্বরে বাবুকে নিয়ে দ্রুত যাই। সেখানে একজন নার্সকে অনুরোধ করলে তিনি স্যালাইন খুলে দেন। এর মধ্যে স্বামীও চলে আসে। পরে দ্রুত বেরিয়ে যাই।’

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বি-ব্লকের পঞ্চম তলায় শিশু হৃদ্‌রোগ আইসিইউতে আগুন লাগে। আইসিইউতে ৭ জন ভর্তি ছিল। ওই রোগীদের পাশে জাতীয় হৃদ্‌রোগ হাসপাতালের আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়েছে। এ ছাড়া বি-ব্লকের ৬টি তলায় বিভিন্ন ওয়ার্ড ও কেবিন মিলিয়ে ১৯৪টি শয্যা রয়েছে। সেখানে মোট ১৭৩ জন রোগী ভর্তি ছিল। আগুনের ঘটনায় রোগী ও স্বজনেরা নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন।