রাজধানীতে আলোকচিত্রী জি এম এম ই করিমের ছবির প্রদর্শনী
‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ’ চলচ্চিত্র ১৯৫৫ সালে নির্মাণ করেছিলেন মাইকেল টড। জুল ভার্নের বিখ্যাত ভ্রমণকাহিনি অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রটির কিছু অংশ ধারণ করা হয়েছিল মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ও চট্টগ্রামের বাড়বকুণ্ডের দুর্গম অঞ্চলে। এ কাজে চলচ্চিত্রকারদের সহযোগিতা করেছিলেন বাংলাদেশের জি এম এম ই করিম।
জি এম এম ই করিম ছিলেন শৌখিন আলোকচিত্রী। সময়কে তিনি ধরে রেখেছিলেন আলোকচিত্রে। তাঁর তোলা দুর্লভ ছবিগুলো নিয়ে রাজধানীর ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে শুরু হয়েছে ‘র্যান্ডম হারভেস্টস’ শীর্ষক প্রদর্শনী। শুক্রবার সন্ধ্যায় একক প্রদর্শনীটি উদ্বোধন করা হয়।
প্রদর্শনীতে জি এম এম ই করিমের ছবিগুলো নিয়ে বই ‘এ ফটোগ্রাফিক—র্যান্ডম হারভেস্টস’–এর মোড়ক উন্মোচন করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, গাইড ট্যুরস–এর প্রধান নির্বাহী হাসান মনসুর এবং জি এম এম ই করিমের দুই ছেলে—সাবেক রাষ্ট্রদূত ইফতেখারুল করিম ও জাবের করিম।
বাবার তোলা আলোকচিত্র প্রসঙ্গে ইফতেখারুল করিম বলেন, ‘এসব ছবি অতীতের সঙ্গে বর্তমানকে যুক্ত করবে। ফলে এই ছবিগুলো, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের ভালো লাগবে।’
বিভিন্ন শখ ছিল জি এম এম ই করিমের। গত শতকের চল্লিশের দশকের মধ্যভাগ থেকে ষাটের দশকের প্রায় শেষ ভাগ পর্যন্ত তাঁর নিত্যসঙ্গী ছিল একটি রোলিফ্লেক্স ক্যামেরা। তাতে তিনি ধারণ করেছিলেন অরণ্য, প্রকৃতি, পরিবার ও জনমানুষের বহু ছবি।
একই সঙ্গে হাতে দম দেওয়া সিনে-ক্যামেরায় ১৯৪৬ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত ধারণ করেছিলেন বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠান, অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে রেলযাত্রা, সুন্দরবন, সিলেট এবং চট্টগ্রামে অরণ্য ও নদীভ্রমণ। আলোকচিত্রগুলো তিনি নিজের হাতে লেখা শিরোনামসহ অ্যালবামে সযত্নে সাজিয়েছিলেন। ভিডিও ধারণ করেছিলেন ৮ মিলিমিটার ফিল্মে, যা পরে ডিজিটাইজ করা হলেও পুরোটা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
জি এম এম ই করিমের আর্কাইভ থেকে যে ভিডিও ক্লিপগুলো পাওয়া গেছে, সেগুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। দেশভাগের ঠিক আগের ও পরের সময়ের আখ্যান পাওয়া যায় এসব আলোকচিত্র ও ভিডিওতে।
ভ্রমণ ও ছবি তোলা জি এম এম ই করিমের নেশা হলেও ক্রমে তা রূপ নেয় পরিবেশ রক্ষার দায়বদ্ধতায়। তাঁর তত্ত্বাবধানে ১৯৬১ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় পর্যটন বিভাগের প্রথম দপ্তর। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের অধীনে ১৯৬৬ ও ১৯৬৭ সালে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত বন্য প্রাণী জরিপে জি এম এম ই করিম ছিলেন একান্ত সহযোগী, যার বিবরণ পাওয়া যায় মাউন্টফোর্ডের ‘দ্য ভ্যানিশিং জঙ্গল’ বইতে।
১৯৬৪ সালে পাকিস্তান শুটিং দলের সঙ্গে জি এম এম ই করিম টোকিও অলিম্পিকে যোগ দেন। পরে বাংলাদেশ শুটিং ফেডারেশন প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা রাখেন। স্বীকৃতি হিসেবে জাতীয় শুটিং ফেডারেশনের মূল ভবনের একটি কক্ষের নামকরণ করা হয়েছে তাঁর নামে।
জি এম এম ই করিমের ছেলেবেলা কেটেছে ঢাকা ও কলকাতায় পারিবারিক পরিমণ্ডলে। বাবা ছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর খান বাহাদুর মোহাম্মদ ফজলুল করিম। মা শরীয়তপুরের হাটুরিয়ার উলফাতুন্নেসা চৌধুরী। জি এম এম ই করিম পড়াশোনা করেছেন রাজধানীর আরমানিটোলায় ও ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে।
পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেন। বিয়ে করেন কলকাতার ডা. মেজর (অব.) দবীরুদ্দিন আহমদের মেয়ে জাইবুন্নেসা আহমেদকে। এই দম্পতির তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। জি এম এম ই করিম ১৯৯৯ সালে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
‘র্যান্ডম হারভেস্টস’ প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী। প্রদর্শনীটির বাছাই বিন্যাস করেছেন শামসুল আলম। প্রদর্শনী চলবে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত। মঙ্গলবার বাদে প্রতিদিন বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত বেঙ্গল গ্যালারিতে প্রদর্শনীটি ঘুরে দেখা যাবে।