বঙ্গবাজারে আগুন: ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও ব্যবস্থা নেয়নি কেউ

আগুনে পুড়ছে রাজধানীর বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স। নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। গতকাল সকালে
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ রাজধানীর ফুলবাড়িয়ার বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সকে চার বছর আগেই অগ্নিনিরাপত্তার দিক থেকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছিল। তখন ফায়ার সার্ভিস থেকে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে বেশ কিছু ব্যানারও টাঙানো হয়েছিল। সবাই জানত এই কমপ্লেক্স বড় ধরনের অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। কিন্তু এরপর সরকারের অন্য কোনো সংস্থা কিংবা বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের দোকানমালিকেরা অগ্নিঝুঁকি প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেননি।

গতকাল মঙ্গলবার ভয়াবহ আগুনে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের সব দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার পর সরকারের কোনো সংস্থাই এখন আর দায় নিতে চাইছে না।

ফুলবাড়িয়ায় বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় পড়েছে। পাশাপাশি লাগোয়া চারটি বিপণিবিতানের সমন্বিত নাম বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স। এর মালিকানায় রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। সিটি করপোরেশনের হিসাবে, টিন-কাঠের অবকাঠামোতে তৈরি বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে ২ হাজার ৯৬১টি দোকান রয়েছে।

কিন্তু বাস্তবে দোকানের সংখ্যা ছিল প্রায় দ্বিগুণ। আবার করপোরেশনের কাগজপত্রে এই বিপণিবিতান দোতলা। কিন্তু কমপ্লেক্সের কিছু অংশ তিনতলা। এই বিপণিবিতানের মালিক সমিতির নেতারা যে যার সুবিধামতো দোকান বাড়িয়ে নেওয়ার পাশাপাশি কমপ্লেক্সের কিছু তৈরি করে নিয়েছিলেন। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি বিপণিবিতান ছাড়াও গতকালের আগুনে আরও চারটি বিপণিবিতান (মার্কেট) আগুনে পুড়ে গেছে।

বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের একটি বিপণিবিতানের দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের বিপণিবিতানের তিনতলায় শুধু সমিতির কার্যালয় এবং একটি মসজিদ করা হয়েছিল। অন্য তিনটি বিপণিবিতানের প্রায় পুরোটাই তিনতলা পর্যন্ত করে কারখানা করা ভাড়া দেওয়া হয়েছিল।

জহিরুল ইসলাম দাবি করেন, ফায়ার সার্ভিস ভুল করে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সকে ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে ব্যানার টাঙিয়েছিল।

তবে ফায়ার সার্ভিস বলছে, জহিরুলের দাবি সত্য নয়। উল্টো ১০ বার বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের মালিক সমিতিকে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মালিক সমিতি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ তদারকি করতে এসে গতকাল দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘২০১৯ সালের ২ এপ্রিল এই ভবনকে আমরা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছি এবং ব্যানার টাঙিয়েছি। এরপর ১০ বার নোটিশ দিয়েছি। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে যা যা করা সম্ভব ছিল, আমরা করেছি। তারপরও এখানে ব্যবসা চলছে।’

সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণে থাকা মার্কেটটি (বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স) যে ‘অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ’, তা জানিয়ে সংস্থাটিকে কোনো নোটিশ দেওয়া হয়েছে কি না এবং তাদের (করপোরেশন) গাফিলতির কারণেই এই অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে কি না, এমন প্রশ্নে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক মো. মাইন উদ্দিন বলেন, ‘এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। যে সংস্থার নাম উচ্চারণ করেছেন, তাদের জিজ্ঞাসা করেন।’

অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বলছে, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের পুরোনো ভবনগুলো ভেঙে নতুন করে অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দোকান মালিক সমিতির নেতাদের বাধার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ টিনের ভবনগুলো ভেঙে নতুন করে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ সূত্র বলছে, সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের সময়ে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সটিকে স্টিলের অবকাঠামো দিয়ে ১০ তলা করতে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এই কাজ করতে ঠিকাদারকে কার্যাদেশও (ভবন নির্মাণের অনুমতিপত্র) দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দোকান মালিক সমিতির নেতারা উচ্চ আদালতে গিয়ে নির্মাণকাজের স্থগিতাদেশ নিয়ে আসেন।

নাম না প্রকাশের শর্তে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগের দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকেও স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারে জোর তৎপরতা চালানো হয়নি। নতুন মেয়র দায়িত্ব নেওয়ার পর ঠিকাদারের কার্যাদেশ বাতিলের ফাইলে অনুমোদন দিয়েছেন। এই বাইরে আর তেমন কিছুই হয়নি।

সিটি করপোরেশনের একাধিক সূত্র বলছে, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে নিয়ন্ত্রণ করতেন রাজনৈতিকভাবে প্রভাশালী কিছু ব্যবসায়ী। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ সব দলের নেতারা মিলেমিশে এই কমপ্লেক্স নিয়ন্ত্রণ করতেন। নতুন ভবন নির্মাণ করা হলে ব্যবসায়ী নেতাদের আধিপত্য কমে যাবে, তাই তাঁরা সেখানে নতুন করে ভবন নির্মাণ করতে দেননি।

উল্লেখ্য, বঙ্গবাজার মার্কেটে এর আগেও কমপক্ষে তিনবার বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এর মধ্যে ১৯৯৫ সালে একবার ভয়াবহ আগুনে পুরো বিপণিবিতান পুড়ে যায়। এ ছাড়া ২০১৮ সালেও একবার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড হয়।

নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, দোকান মালিক সমিতির কিছু নেতার ব্যক্তিগত স্বার্থ ও সুবিধা নেওয়ার মানসিকতার কারণে হাজার পরিবার আজ পথে বসল। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ঝুঁকিপূর্ণ, এটি বিবেচনায় নিয়েই সেখানে আধুনিক ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু যারা এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়াল, তারা সবাই কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। কাজটি তারা করেছিল শুধু নিজেদের স্বার্থে, টাকার লোভে।

স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র নিজে একজন ব্যারিস্টার। তিনি কী কারণে এত দিন আইনিভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি মোকাবিলা করেননি। ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও বঙ্গবাজারে অবৈধভাবে ব্যবসা করতে যাওয়ার ফলাফল কী, সেটি সেবাই দেখল। বহু মানুষ নিঃস্ব হলো, হাজার কোটি টাকার সম্পদ পুড়ে গেল। পুরান ঢাকায় একের পর এক অগ্নিকাণ্ডে জীবন ও সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে। এভাবে চলতে পারে না। এর দায় কাউকে না কাউকে নিতে হবে।’