সময়ের মুখ

বাচ্চাটা আমার কাছে আছিল, মায়া লাগতাছে

রাজধানীর মিরপুরে কমার্স কলেজ-সংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তির চায়ের দোকানি আমেনা বেগম (৪৫)। হঠাৎ কোলে আসা এক সাত মাস বয়সী শিশুর জন্য তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে। হোসাইন নামের শিশুটির মা, বাবা ও বোন গত বৃহস্পতিবারের বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার কারণে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান। আহত হোসাইনকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন আমেনা এবং বৃষ্টি নামের একজন হিজড়া। আমেনার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুহাদা আফরিন

সাত মাস বয়সী হোসাইনের পাশে আমেনা বেগম
ছবি: প্রথম আলো
প্রশ্ন:

আপনিও কি ঝিলপাড়ে থাকেন?

আমেনা: ১৩ বছর এই বস্তিতে আছি। আমার জন্ম ঢাকায়। বাড়ি বগুড়া।

আরও পড়ুন
প্রশ্ন:

গত বৃহস্পতিবার বৃষ্টির সময়ে আপনি কোথায় ছিলেন?

আমেনা: বৃষ্টির সময় ঘরে ছিলাম। তখন আমার মেয়ে বলতাছে, মা একটা লোক মইরা পইড়া আছে। আমরা দৌড়ায়া গেছি। তখন কে জানি আমার হাতে বাচ্চাটা দিল।

আরও পড়ুন
প্রশ্ন:

এরপর কী করলেন?

আমেনা: আমি ওরে নিয়া একটা ঘরে ঢুইকা গেলাম। বাচ্চাটার কাপড়চোপড় খুইল্লা তেল গরম কইরা গায়ে মাখি। পরে দেখি শইলডা গরম হয়, নিশ্বাস ফালাইল। তেল–পানি নিয়ে যখন শরীর গরম করছি, সবাই মিলেই বলছিল আপনি ওরে নিয়া হাসপাতাল যান। তখন সবাইকে বলছি যে, যে যা পারো টাকা দাও, ওরে হাসপাতালে নেওয়া লাগবে। সবাই সাহায্য করছে। ৫০০–৬০০ টাকার মতো উঠছে।

প্রশ্ন:

হাসপাতালে কীভাবে যান?

আমেনা: এই বৃষ্টির মইধ্যে হাঁটুসমান পানি ভাইঙ্গা সিএনজি (অটোরিকশা) নিয়া চইলা গেছি।

প্রশ্ন:

আপনার সঙ্গে কে কে হাসপাতালে যান?

আমেনা: বৃষ্টি নামের একজন হিজড়া, বাচ্চার একজন মামা ও এলাকার দু-একজন সঙ্গে ছিলেন।

প্রশ্ন:

কোন হাসপাতালে নিয়ে গেলেন?

আমেনা: প্রথমে আমি মিরপুর ২ নম্বরে একটা হাসপাতালে নিই। ওরা ভর্তি করে নাই। পরে শ্যামলীর শিশু হাসপাতালেও ভর্তি করে নাই। সেখান থেকে শেখ হাসিনা বার্ন হাসপাতালে যাই (শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট)। সেখান গিয়ে চিল্লাচিল্লি করার পরে একজন বলে ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে বলতে যে বাচ্চাটার সবাই মারা গেছে। ওর চিকিৎসা লাগব। পরে ঢাকা মেডিকেলে নিলে ভর্তি করে।

প্রশ্ন:

হাসপাতালে কখন ভর্তি করেন?

আমেনা: ৯টা বাজে নিই। ১২টা বাজে ভর্তি করাইতে পারি।

প্রশ্ন:

সারা রাত শিশুটির সঙ্গে কে ছিলেন?

আমেনা: আমি আর বৃষ্টি ছিলাম। ভোররাতে বাচ্চার এক খালা আসে। তখন আমি বাসায় যাই। পরে সকালে আবার হাসপাতালে আইসা দেখি ওরে নিয়া যাইতেছে। ওর বাপ-মা–বইনের লাশ সোহরাওয়ার্দীর মর্গে ছিল। সেখান থেকে বাচ্চাটারে নিয়ে থানায় গিয়ে ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) সাহেবের কাছে যাই। সে আমাকে বাসায় যাইতে বলে।

প্রশ্ন:

শিশুটিকে তার দাদার কাছে দেওয়ার আগে আপনার কাছেই ছিল?

আমেনা: বরিশালে ওর বাপ-মা–বইনের লাশ নেওনের আগপর্যন্ত আমার বাসায়ই আছিল। দুধ গরম করে খাওয়াইছি। খালি কান্নাকাটি করত। কিন্তু কোলে নিলে ঠান্ডা হইত।

প্রশ্ন:

শিশুটির পরিবারকে আগে থেকে চিনতেন?

আমেনা: নানা-নানিকে চিনতাম। বাচ্চার নানার বাড়ি এই বস্তিতেই। ওরা থাকত বিসিআইসি কলোনিতে। গত শুক্রবার রাতে সবার সামনে দাদার হাতে বাচ্চাটারে দিয়া দেই।

প্রশ্ন:

শিশুটিকে নিয়ে আপনি এত ছোটাছুটি কী ভেবে করলেন?

আমেনা: ও তো একটা বাচ্চা। ওর সব মইরা গেল। খারাপ লাগছিল। মনে হয় বাচ্চাটা অহনো আমার কোলের ভিতরে আছে। মনে হয় কোলেই রাখছি। বাচ্চাটা আমার কাছে আছিল, মায়া লাগতাছে। বাচ্চাটারে জানি আল্লাহ বাঁচাইয়া রাখে। আমি ওরে দুই দিন পালছি।

প্রশ্ন:

আপনার পরিবারে কে কে আছেন?

আমেনা: আমার চার ছেলে ও এক মেয়ে। স্বামী অটোরিকশা চালান। আমি চায়ের দোকান চালাই।