ঢাকা উত্তর সিটিতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসূতিসেবা দিতে ডাকতে হয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক

স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রতিদিন ৪০ জন রোগী দেখার কথা। প্রায়ই দ্বিগুণ বা তিন গুণ রোগী আসেন। কিন্তু জনবলকাঠামোতে চিকিৎসকের পদ একটি।

সেবাগ্রহীতাদের ভিড় জহুরুল ইসলাম নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সম্প্রতি তোলাপ্রথম আলো

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আওতাধীন মাতৃসদনগুলোতে দিনে ২৪ ঘণ্টা করে সপ্তাহে সাত দিনই অন্তঃসত্ত্বা নারীদের প্রসবকালীন সেবা দেওয়া হয়। জটিলতা থাকলে দেওয়া হয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের সেবাও। অথচ জনবলকাঠামোতেই নেই অস্ত্রোপচারের জন্য অ্যানেসথেসিয়া (অবেদনবিদ) চিকিৎসকের পদ।

এ ছাড়া রোগী ভর্তি, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষা, স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসব করানোর মতো সেবা দিতে একটি মাতৃসদনে যে জনবল প্রয়োজন, তা-ও মাতৃসদন পরিচালনা প্রকল্পের কাঠামোতে নেই। এসব মাতৃসদন পরিচালনার দায়িত্বে আছে বেসরকারি সংস্থাগুলো। জরুরি ভিত্তিতে কোনো রোগীকে প্রসূতিকালীন সেবা দিতে গেলে তাদের বিপাকে পড়তে হয়। কখনো সেবা দিতে বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞ ডেকে আনা লাগে।

অন্যদিকে ডিএনসিসিতে যেসব নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে, কম খরচে সেবা নিতে সেখানে প্রতিদিন নিম্ন আয়ের ও দরিদ্র শ্রেণির অনেক মানুষ চিকিৎসা নিতে যান। একেকটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বহির্বিভাগে প্রতিদিন ৪০ জন রোগী দেখার কথা। কিন্তু গড়ে দ্বিগুণ বা তিন গুণ রোগী দেখতে হয়।

আরও পড়ুন

মাতৃসদন ও নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের (এনজিও) কর্মকর্তারা বলছেন, হাসপাতাল (মাতৃসদন ও নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র) পরিচালনায় যে ধরনের জনবলকাঠামোর প্রয়োজন, প্রকল্পে এসবের অনেক কিছুই নেই। আবার কাঠামোতে বিভিন্ন পদে যে জনবলের উল্লেখ রয়েছে, সেসব পদে এর চেয়ে বেশি জনবলের চাহিদা রয়েছে।

আলট্রাসনোগ্রাম-অ্যানেসথেসিয়ায় কেউ নেই

মাতৃসদনগুলোর একেকটি পরিচালনার কাঠামোতে জনবল রয়েছে ৩২ জন। দুজন গাইনি ও শিশুবিশেষজ্ঞের পাশাপাশি চারজন চিকিৎসা কর্মকর্তার পদ রয়েছে। নার্সের পদ আছে চারটি।

আলট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে চিকিৎসকেরা নারীর গর্ভের সন্তানের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য জানতে পারেন। এ কারণে একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীর জন্য এ পরীক্ষা জরুরি। মাতৃসদনের এ সেবার চাহিদাও বেশি। কিন্তু জনবলকাঠামোতে মাতৃসদনের জন্য আলট্রাসনোগ্রাম যন্ত্র পরিচালনাকারীর কোনো পদ নেই।

আবার জটিলতা থাকলে বা হঠাৎ জটিলতা দেখা দিলে বিকল্প হিসেবে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করাতে হয় অনেক নারীর। কিন্তু অস্ত্রোপচারের জন্য অ্যানেসথেসিয়া (অবেদনবিদ) বিভাগে যে চিকিৎসক প্রয়োজন, সেই পদও জনবলকাঠামোতে নেই।

এ ছাড়া বিভিন্ন প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করাতে ল্যাব টেকনিশিয়ান আছেন মাত্র একজন। তাঁকে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। কিন্তু প্রায়ই বিকেলের পর কিংবা রাতে অনেক নারী প্রসবব্যথা নিয়ে মাতৃসদনে আসেন, যাঁদের আগে থেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো থাকে না।

বেসরকারি সংস্থা নারী মৈত্রী ঢাকা উত্তর সিটির অঞ্চল-৫–এর মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ি এলাকার মাতৃসদন পরিচালনা করে। নারী মৈত্রীর প্রকল্প ব্যবস্থাপক রেহানা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘অ্যানেসথেসিস্ট হায়ার করে আনতে হয়। আর চুক্তিতে একজন আলট্রাসনোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে তাঁর ডিউটি সকাল থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত। এর পরে প্রয়োজন হলে বাইরে থেকে ডেকে আনা লাগে।’ ল্যাব টেকনিশিয়ানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে আমাদের ল্যাব টেকনিশিয়ান রয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে তাঁদের ডেকে এনে কোনোরকমে কাজ করাই। মাতৃসদনে এই পদে অন্তত দুজন দরকার।’

সেবাপ্রার্থী দ্বিগুণ-তিন গুণ

ঢাকা উত্তর সিটিতে নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বহির্বিভাগে রোগী দেখা হয়। ৫০ টাকায় টিকিট কেটে সাধারণ মানুষ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন।

স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিচালনাকারী বেসরকারি সংস্থাগুলো বলছে, তাদের প্রতিদিন ৪০ জন করে রোগী দেখার কথা। কিন্তু প্রায় সময়ই দ্বিগুণ বা তিন গুণ রোগী আসেন। কিন্তু স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জনবলকাঠামোতে চিকিৎসকের পদ একটি।

রাজধানীর মিরপুরের বর্ধিত পল্লবী এলাকায় অবস্থিত জহুরুল ইসলাম নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, শতাধিক নারী-পুরুষ চিকিৎসক দেখাতে অপেক্ষা করছেন। স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি পরিচালনা করে বেসরকারি সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রিভেনশন অব সেপটিক অ্যাবরশন (বাপসা)। কেন্দ্রটির প্রকল্প ব্যবস্থাপক সামসুন নাহার প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিদিন ১০০-১২০ জন রোগী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসেন, যা আমাদের লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুণের বেশি।’

৩৩ ওয়ার্ডে নেই সরাসরি সেবা

ঢাকা উত্তর সিটির ১০টি অঞ্চলে ওয়ার্ড ৫৪টি। বিপরীতে মাতৃসদন ও নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর অবস্থান ৬টি অঞ্চলের ২১টি ওয়ার্ডে। এসব ওয়ার্ডে ৬টি মাতৃসদন ও ৩০টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে মানুষকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে একটির বেশি স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু ৩৩টি ওয়ার্ডের বাসিন্দারা সরাসরি নিজেদের ওয়ার্ড এলাকা থেকে স্বল্পমূল্যে এই চিকিৎসাসেবা নেওয়ার সুযোগ পান না।

ঢাকা উত্তর সিটির অঞ্চল-৪–এর মিরপুর এলাকায় মাতৃসদন পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা আহ্‌ছানিয়া মিশনের প্রকল্প ব্যবস্থাপক নায়লা পারভিন প্রথম আলোকে বলেন, এখানে যেকোনো ওয়ার্ড থেকে এসে মানুষ সেবা নিতে পারেন। তবে প্রতিটি ওয়ার্ডে সেবা দেওয়া সম্ভব হলে মানুষ বেশি উপকৃত হতেন।