‘আমরা সবাই ভাই ভাই, আমাদের মাঝে বিরোধ নাই’

মৌখিক শান্তিচুক্তির পর বিজয় চিহ্ন দেখাচ্ছেন ঢাকা কলেজ ও ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরাছবি: প্রথম আলো

ঢাকা কলেজ ও ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা বিরোধ অবশেষে অবসান ঘটতে যাচ্ছে। নিউমার্কেট থানা–পুলিশের মধ্যস্থতায় দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে এবার একটি মৌখিক শান্তিচুক্তি হয়েছে।

আজ রোববার দুপুরে চুক্তি শেষে উভয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রতিজ্ঞা করেছেন, তাঁরা আর মারামারি করবেন না। এ সময় তাঁরা স্লোগান দেন, ‘আমরা সবাই ভাই ভাই, আমাদের মাঝে বিরোধ নাই’।

এই মৌখিক শান্তিচুক্তি উপলক্ষে ঢাকা কলেজের শহীদ আ ন ম নজীব উদ্দিন খান খুররম মিলনায়তনে মিলিত হন দুই কলেজের শিক্ষার্থীরা। এ সময় ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ এ কে এম ইলিয়াস, উপাধ্যক্ষ পারভীন সুলতানা হায়দার, ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মুহাম্মদ রেযওয়ানুল হক এবং নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে এম মাহফুজুল হক উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, জাতীয় ছাত্রশক্তিসহ বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুপুর ১২টার দিকে ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাকা কলেজ মিলনায়তনে আসেন। তবে এবার আর উত্তেজনা হয়নি, তাঁদেরকে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা গোলাপ ও রজনীগন্ধা ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। চুক্তি শেষে ঢাকা কলেজের পক্ষ থেকে তাঁদেরকে মিষ্টিমুখও করানো হয়। পরে উভয় পক্ষ বিরোধে না জড়ানোর অঙ্গীকার করে স্লোগান দেন।

এ বিষয়ে ঢাকা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী হাসিমুজ্জামান জিহাদ বলেন, ‘আমরা সবাই চাই সায়েন্স ল্যাবের আতঙ্ক শেষ হোক। কিছু হলেই সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া বন্ধ হোক। এই সংঘর্ষে আমরা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। আশা করছি, এই শান্তিচুক্তির মাধ্যমে আমরা মিলেমিশে চলতে পারব।’

আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থী তৌফিক হাসান বলেন, ‘দুই কলেজের বিরোধ নিয়ে আগে কখনো এমন আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আজকে আমরা ঢাকা কলেজে এসেছি। এবার আমরা বিরোধে না জড়ানোর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছি। আশা করি, আমরা এটা পালন করতে পারব।’

যতবার সংঘর্ষ হয়েছে, আমরা কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখেছি খুবই তুচ্ছ কারণে তারা মারামারি করেছে। প্রায় প্রতিদিনই তারা ছোটখাটো ঝামেলা করে।
এ কে এম মাহফুজুল হক, ওসি, নিউমার্কেট থানা

শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মুহাম্মদ রেযওয়ানুল হক বলেন, ‘আজকে আমাদের জন্য খুবই আনন্দের একটি দিন। কেননা, বিগত দিনে বিভিন্ন সময়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা ঝামেলায় জড়িয়েছে। এই আলোচনার পর শিক্ষার্থীদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, আর কোনো প্রকার ঝামেলায় না জড়িয়ে শান্তিপূর্ণভাবে পড়াশোনা করবেন।’

ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াস বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ভুল–বোঝাবুঝি ও সংঘর্ষের কারণে আমাদের শিক্ষাজীবন ও সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হচ্ছিল। এ অবস্থার অবসান খুবই জরুরি ছিল। তাই আজকের এই শান্তি ও সম্প্রীতির উদ্যোগকে আমরা আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাই। এভাবেই আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাব।’

মধ্যস্থতার উদ্যোগ নিয়ে নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে সংঘর্ষ হলে আমরা শিক্ষকদের নিয়ে আলোচনায় বসতাম। কিন্তু যাদের নিয়ে আলোচনা, তারাই সেখানে থাকত না। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই স্থায়ী সমাধান খুঁজছিলাম। হঠাৎ মনে হলো—যাদের নিয়ে সমস্যা, তাদের সঙ্গে কথা বলা দরকার। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম তারাও সমঝোতায় রাজি আছে। পরে দুই কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে এই আয়োজন করেছি।

মৌখিক শান্তিচুক্তির পর ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের এক শিক্ষার্থীকে মিষ্টিমুখ করাচ্ছেন ঢাকা কলেজের এক শিক্ষার্থী
ছবি: প্রথম আলো

সংঘর্ষ ঠেকাতে পাঁচ সদস্যের কমিটি

দুই কলেজের শান্তিচুক্তির পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদে সংঘর্ষ এড়াতে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। চুক্তির পরে ভবিষ্যতে কোনো শিক্ষার্থী বিরোধে জড়ালে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে এই কমিটি কাজ করবে বলে জানা গেছে।

নিউমার্কেট থানা সূত্র জানায়, পাঁচ সদস্যের এই কমিটিতে ঢাকা কলেজের দুজন শিক্ষক, ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের দুজন শিক্ষক এবং পুলিশের একজন প্রতিনিধি থাকবেন। আজকের পর থেকে শিক্ষার্থীরা আবার সংঘর্ষে জড়ালে, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির সুপারিশ করবে এই কমিটি।

সাড়া দেয়নি সিটি কলেজ

ঢাকা কলেজ ও নিউমার্কেট থানা সূত্রে জানা গেছে, শান্তিচুক্তি করতে প্রথমে নিউমার্কেট থানার পক্ষ থেকে ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ ও ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের অধ্যক্ষদের আহ্বান জানানো হয়। এই আহ্বানে দুই কলেজ ইতিবাচক হলেও সিটি কলেজ সাড়া দেয়নি।

এ বিষয়ে ওসি মাহফুজুল হক বলেন, ‘আমরা তিনটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই যোগাযোগ করেছি। তবে সিটি কলেজের প্রস্তুতি ছিল না বলে তারা এই আয়োজনে অংশ নিতে পারেনি। নিউমার্কেট, সায়েন্স ল্যাব এলাকায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আগামীতেও এই চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’

এক বছরে ১৫ বার সংঘর্ষ

ঢাকা কলেজ ও নিউমার্কেট থানা সূত্র জানায়, নিউমার্কেট ও সায়েন্স ল্যাব এলাকায় ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের ভোগান্তির অন্যতম কারণ এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা। গত এক বছরে নানা কারণে ঢাকা কলেজ, আইডিয়াল কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা কমপক্ষে ১৫ বার সংঘর্ষে জড়িয়েছেন। এর মধ্যে সর্বশেষ ছয় মাসে তাঁরা তিনটি বড় সংঘর্ষে জড়ান।

পুলিশ জানায়, সংঘর্ষের পর তিনটি কলেজের অধ্যক্ষ, শিক্ষক, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে আলোচনা করে সমাধানের চেষ্টা হলেও তা কাজে আসেনি। তবে এবারই প্রথম শিক্ষার্থীদের নিয়ে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে ওসি মাহফুজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘যতবার সংঘর্ষ হয়েছে, আমরা কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখেছি খুবই তুচ্ছ কারণে তারা মারামারি করেছে। প্রায় প্রতিদিনই তারা ছোটখাটো ঝামেলা করে।’