ভুয়া ছবি ও ডিপফেক এখন সাংবাদিকতার বড় চ্যালেঞ্জ: প্রেস সচিব

প্রশিক্ষণ কর্মশালার সমাপনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। আজ শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতেছবি: সংগৃহীত

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই সাংবাদিকতার কাঠামো দ্রুত বদলে দিচ্ছে। কাজের গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভুল তথ্য, ভুয়া ছবি ও ডিপফেকের ঝুঁকিও বেড়েছে। এই বাস্তবতায় সাংবাদিকতার মূল নীতি অটুট রেখে এআই ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

আজ শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) শফিকুল কবির মিলনায়তনে দুই দিনব্যাপী ‘এআই পাওয়ার্ড জার্নালিজম: অপারচুনিটি, রিস্ক অ্যান্ড ডিজিটাল সিকিউরিটি’ শীর্ষক প্রশিক্ষণ কর্মশালার সমাপনী অনুষ্ঠানে শফিকুল আলম এ কথা বলেন।

টেক প্রতিষ্ঠান ও খেলাধুলাবিষয়ক বিশ্বের প্রথম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গেমপ্লিফাই এক্সওয়াইজেডের পৃষ্ঠপোষকতায় ডিআরইউ সদস্যদের জন্য এই কর্মশালার আয়োজন করা হয়।

ডিআরইউ সভাপতি আবু সালেহ আকনের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন গেমপ্লিফাই এক্সওয়াইজেডের প্রধান নির্বাহী (সিইও) মাহফুজুর রহমান এবং ডিআরইউ তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ সম্পাদক মাহমুদ সোহেল।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে শফিকুল আলম বলেন, সাংবাদিকতা এআইনির্ভর হোক বা না হোক, এর মৌলিক নীতিমালা কখনোই বদলাবে না। প্রতিটি তথ্যের সুনির্দিষ্ট সূত্র থাকতে হবে এবং প্রতিটি উদ্ধৃতি হতে হবে শতভাগ নির্ভুল। এই জায়গায় কোনো আপসের সুযোগ নেই।

প্রেস সচিব বলেন, সঠিকভাবে এআই ব্যবহার করলে সাংবাদিকদের উৎপাদনশীলতা ৩০ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। এআই টুলের মাধ্যমে একজন সাংবাদিক একাই শিপিং, কৃষি গবেষণা বা জলবায়ুর মতো কোনো নির্দিষ্ট খাত নিয়ে বড় আকারের ওয়েবসাইট বা তথ্যভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম পরিচালনা করতে পারেন। এতে ক্যারিয়ারের নতুন সুযোগ তৈরির পাশাপাশি বিশেষায়িত সাংবাদিকতার ক্ষেত্রও প্রসারিত হচ্ছে।

তবে এআইয়ের সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হিসেবে ভুয়া ছবি, ভিডিও ও ফটোকার্ডের অপব্যবহার তুলে ধরে শফিকুল আলম বলেন, এআই ব্যবহার করে দীর্ঘ বক্তৃতা বা বক্তব্যকে এমনভাবে কাটছাঁট ও বিকৃত করা যায়, যা দেখে বা শুনে সাধারণ মানুষের পক্ষে আসল বক্তব্য বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। এ ধরনের কনটেন্ট সমাজে বিভ্রান্তি তৈরি করছে এবং পরিকল্পিতভাবে জনমতকে প্রভাবিত করার হাতিয়ারে পরিণত হচ্ছে।

নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে শফিকুল আলম বলেন, ‘ডিপফেকের কারণে এখন প্রতিনিয়ত ফটোকার্ডের অত্যাচার শুরু হয়েছে। আমি নিজেই এর শিকার হয়েছি। আমার ২৭ মিনিটের বক্তব্য এমনভাবে জোড়াতালি দিয়ে এক মিনিটে নামিয়ে আনা হয়েছে, যা অবিশ্বাস্য।’

কর্মশালা শেষে কুইজ প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার দেওয়া হয়। আজ শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে
ছবি: সংগৃহীত

ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা এক্সের মতো বড় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর দায়বদ্ধতা নিয়েও কথা বলেন শফিকুল আলম। তিনি বলেন, এসব প্ল্যাটফর্ম ‘ফ্রিডম অব প্রেস’ বা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার যুক্তি দেখিয়ে অনেক সময় ঘৃণা ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর সুযোগ করে দেয়, অথচ তাদের কার্যকর কোনো দায়বদ্ধতা নেই।

এআইয়ের অপব্যবহার গণতন্ত্রের জন্যও বড় হুমকি হয়ে উঠছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এআই লিটারেসি বা এআই শিক্ষা একটি বাধ্যতামূলক বিষয়। এটি ছাড়া বর্তমানে সাংবাদিকতা করা অসম্ভব। এটি কেবল ক্যারিয়ারের উন্নতির জন্য নয়, বরং ভুয়া তথ্য ও ডিপফেক শনাক্ত করে গণতন্ত্র এবং সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার জন্যও প্রয়োজন।’

এআইকে একটি ধারালো ছুরির সঙ্গে তুলনা করে শফিকুল আলম বলেন, ‘এআইয়ের ব্যবহার অনেকটা ধারালো ছুরির মতো। এটি দিয়ে যেমন দ্রুত কাজ শেষ করে জীবন সহজ করা যায়, তেমনি অসাবধানতায় এটি ভুল হাতে পড়লে বড় ধরনের ক্ষত বা সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে। তাই এই ছুরি চালানোর সঠিক বিদ্যা বা লিটারেসি অর্জন করাই এখন সাংবাদিকদের মুক্তির পথ।’

সমাপনী বক্তব্যে ডিআরইউ সভাপতি আবু সালেহ আকন ভারতীয় ও ভিনদেশি আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রাপ্ত প্রযুক্তিগত জ্ঞান কাজে লাগানোর আহ্বান জানান।

ডিআরইউর সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেল বলেন, ‘প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাংবাদিকদের প্রস্তুত করতেই এই ব্যতিক্রমধর্মী প্রশিক্ষণের আয়োজন। কোন কনটেন্ট এআই দিয়ে তৈরি আর কোনটি নয়, তা যাচাই করার সক্ষমতা এখন সাংবাদিকদের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এআই কীভাবে কাজ করে এবং এর সীমাবদ্ধতা কী, সেটি জানা না থাকলে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা সম্ভব নয়। তবে এআই সাংবাদিকের বিকল্প নয়, বরং শক্তি বাড়ানোর হাতিয়ার।’ তথ্যপ্রযুক্তিতে রিপোর্টারদের এগিয়ে রাখতে বছরজুড়ে এমন কর্মশালা ডিআরইউ অব্যাহত রাখবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল থেকে জুমে যুক্ত হয়ে গেমপ্লিফাই এক্সওয়াইজেডের প্রতিষ্ঠাতা মশিউর রহমান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাব থেকে বেরিয়ে সুস্থ পরিবেশ গড়ার ওপর গুরুত্ব দেন এবং গণমাধ্যমকর্মীদের তথ্য যাচাইয়ে আরও সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানান।

দুই দিনের এই কর্মশালায় সাংবাদিকদের চ্যাটজিপিটির ব্যবহার, ফ্যাক্ট চেক, ডেটা জার্নালিজম ও বিভিন্ন এআই টুলের ব্যবহার শেখানো হয়। কর্মশালা শেষে কুইজ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হন ডিআরইউ সদস্য সাইফ খন্দকার, গাযী আনোয়ার ও আল আমিন আজাদ।

এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন ডিআরইউ সহসভাপতি মেহ্দী আজাদ মাসুম, যুগ্ম সম্পাদক জাফর ইকবাল, সাংগঠনিক সম্পাদক এম এম জসিম, নারীবিষয়ক সম্পাদক জান্নাতুল ফেরদৌস পান্না, আপ্যায়ন সম্পাদক আমিনুল হক ভূঁইয়া এবং কার্যনির্বাহী সদস্য আল আমিন আজাদ, সুমন চৌধুরী ও মো. মাজাহারুল ইসলাম।