বিপুল ব্যয়ের ভবন কাজে লাগে না

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহুতল ভবন নির্মাণ করে বছরের পর বছর ফেলে রাখা রাষ্ট্রীয় সম্পদের বিরাট অপচয়।

তিন বছর ধরে খালি আগারগাঁওয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জন্য নির্মিত ভবনটি
খালেদ সরকার

সচিবালয় থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে সরিয়ে নিতে ১৩ তলাবিশিষ্ট একটি কমপ্লেক্সের নির্মাণকাজ শেষ হয় তিন বছর আগে। নির্বাচন কমিশন–লাগোয়া কমপ্লেক্সটিতে বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা হবে, প্রযুক্তির বিকাশ হবে, দেশের সব বিজ্ঞানীর মিলনমেলা ঘটবে—এটি ছিল উদ্দেশ্য।

২২৯ কোটি টাকা খরচ করে নির্মিত জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কমপ্লেক্সটি এখনো ফাঁকা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা সচিবালয়েই থাকতে চায়। আগারগাঁওয়ে যেতে চায় না।

এ অবস্থায় কমপ্লেক্সের বিভিন্ন ফ্লোর সরকারের অন্য সংস্থাকে ভাড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যদিও যাদের ভাড়া দেওয়া হয়েছে, তারা এখনো ওঠেনি। ফলে বিপুল অর্থ ব্যয় করে যে উদ্দেশ্য নিয়ে কমপ্লেক্সটি নির্মিত হলো, তা পূরণ হচ্ছে না।

ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি
বিপুল টাকা ব্যয় করে নির্মিত ভবনগুলো খালি পড়ে থাকায় বোঝা যায় পরিকল্পনায় গলদ ছিল। এতে জবাবদিহির ঘাটতি প্রকাশ পায়।
ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি

এবার ঢাকার পাশের জেলা নারায়ণগঞ্জের দিকে তাকানো যাক। শহরের শায়েস্তা খান সড়কে ৩২ কোটি টাকায় নির্মিত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবনটি তিন বছর ধরে খালি পড়ে আছে।

চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে আটতলা ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল। স্থানীয় আইনজীবীরা জানিয়েছেন, তাঁরা নবনির্মিত ভবনে উঠবেন না। কারণ, জেলার ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন থেকে ওই ভবনটির দূরত্ব বেশি। এই ভবনটিও সরকারের অন্য কোনো দপ্তরকে ভাড়া দেওয়ার আলোচনা চলছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি নবনির্মিত সরকারি ভবন খালি পড়ে থাকার তথ্য মিলেছে। এর আগে রাজধানীর বেইলি রোডে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স, পুরান ঢাকায় ঢাকা জেলা পরিষদ ভবন, বগুড়ায় আজিজুল হক কলেজের ছাত্রী হলসহ বেশ কয়েকটি ভবনের পড়ে থাকার খবর প্রকাশিত হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহুতল ভবন নির্মাণ করে বছরের পর বছর ফেলে রাখা রাষ্ট্রীয় সম্পদের বিরাট অপচয়। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতি থাকায় এ ঘটনা বাড়ছে, যা খুবই উদ্বেগজনক।

জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কমপ্লেক্স অব্যবহৃত ৩ বছর

নবনির্মিত জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কমপ্লেক্সে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প এবং জাতীয় বিজ্ঞান জাদুঘরের অফিস স্থানান্তরের কথা। কিন্তু নতুন ভবনে ওঠেনি কোনো দপ্তরই।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁদের বেশির ভাগ কাজ সচিবালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে। আগারগাঁওয়ে চলে গেলে তাঁরা যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন।

গত ২৮ সেপ্টেম্বর সরেজমিন জানা গেল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ফ্লোর বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ ট্রাস্ট, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি, বাংলাদেশ প্রকৌশল গবেষণা পরিষদ এবং বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমিকে ভাড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব জিয়াউল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সচিবালয় পুরোনো জায়গা। সেখানে থাকতে অনেকের আগ্রহ থাকে। তবে নতুন ভবনে মন্ত্রণালয় যাবে না, এমন সিদ্ধান্তের কথা এখনই বলা যাবে না।

যদিও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের মহাপরিচালক মুনীর চৌধুরী জানান, ভবনটি নিয়ে আগে যে পরিকল্পনা ছিল, তাতে পরিবর্তন এসেছে। নতুন কয়েকটি দপ্তর এখানে আসবে।

৩ বছর খালি নারায়ণগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন
‘৬৪ জেলায় চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন’ নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় তিন বছর আগে নির্মিত হয়েছিল নারায়ণগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবনটি।

আইনজীবীরা বলছেন, নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত এলাকা থেকে নবনির্মিত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবনের দূরত্ব দুই কিলোমিটার। এত দূরে গিয়ে জনগণকে সেবা দেওয়া কঠিন। নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতির সভাপতি হাসান ফেরদৌস বলেন, দেশের সব জেলাতেই ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এবং জেলা ও দায়রা জজ আদালত পাশাপাশি থাকে। ব্যতিক্রম শুধু নারায়ণগঞ্জ।

সেখানে ভবন নির্মাণ না করতে একাধিকবার আপত্তি জানানো হয়েছিল। কিন্তু কেউ কথা শোনেনি। আইনজীবীরা বলছেন, এখানে আসামি, বিচারক ও আইনজীবীদের নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত। অনেক সময় একই আসামির দুই জায়গায় হাজিরা থাকে। বিচারপ্রার্থী মানুষ দুই কিলোমিটার রাস্তা যাতায়াত করে একবার জজ কোর্ট, আরেকবার ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে দৌড়াদৌড়ি করবে। এতে মানুষের ভোগান্তি বাড়বে।

জানা গেছে, আইন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন সবাই এরই মধ্যে ভবনটি পরিদর্শন করেছেন। ওই ভবনে হার্ট ইনস্টিটিউট করা যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভবন খালি সাত মাস

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পঙ্গু হাসপাতালের ঠিক বিপরীতে নির্মিত হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর ভবন। রাজস্ব খাতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ১২ তলাবিশিষ্ট দৃষ্টিনন্দন রাজস্ব ভবনটি বানানোর কাজ শেষ হয় গত ফেব্রুয়ারিতে। যদিও প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয় ৩০ জুন। এখন পর্যন্ত এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নতুন ভবনে ওঠেননি।

সাত মাস ধরে ভবনটি ফাঁকা পড়ে আছে। ভবনটি নির্মাণে খরচ হয়েছে ৪৫১ কোটি টাকা।  ২০০৮ সালে প্রকল্পের শুরুতে ব্যয় ছিল ১৪১ কোটি টাকা। নকশা পরিবর্তনের কারণে খরচ বেড়ে যায়। গণপূর্ত অধিদপ্তর থেকে একাধিকবার ভবনটি হস্তান্তরের অনুরোধ জানানো হলেও এনবিআর তা বুঝে নিচ্ছে না।

রাজস্ব ভবনের প্রকল্প পরিচালক লুৎফুল আজিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে আমরা ভবনটি উদ্বোধন করতে চাই। সে জন্য কিছুটা দেরি হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘নভেম্বরে জাতীয় কর মেলা। ওই সময় আমাদের ব্যস্ততা থাকবে। ডিসেম্বর নাগাদ ভবনটি উদ্বোধনের সম্ভাবনা রয়েছে।

তথ্য কমিশন ভবনে বিদ্যুৎ–সংযোগে গাফিলতি

জনগণের তথ্য পাওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করতে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্মিত হয়েছে ১৩ তলা তথ্য কমিশন ভবন। ৪২ কোটি টাকা খরচ করে নির্মিত ভবনটির প্রকল্পের মেয়াদ গত জুনে শেষ হয়। যদিও এখন পর্যন্ত ভবনটি গণপূর্ত অধিদপ্তরকে হস্তান্তর করেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ভবনটি নির্মাণের সময় বিদ্যুৎ–সংযোগের ছাড়পত্র নেয়নি বাস্তবায়নকারী সংস্থা গণপূর্ত অধিদপ্তর ও প্রকল্প পরিচালক।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী মসিউর রহমান জানালেন, ‘ভবন নির্মাণকাজ শেষ। বিদ্যুৎ–সংযোগ পেতে দেরি হয়েছে। ভবনটি আমরা গণপূর্ত অধিদপ্তরের কাছে হস্তান্তর করব। গণপূর্ত সেটি তথ্য কমিশনকে বুঝিয়ে দেবে। এরপর তারা ভবনে উঠবে।’

তথ্য কমিশনের উপপরিচালক (প্রশাসন) মাহবুবুল আহসান বলেন, ‘যতটুকু জেনেছি, বিদ্যুতের সংযোগ পেতে সমস্যা ছিল। আশা করছি, ডিসেম্বরের মধ্যে ভবনে ওঠা যাবে।’
বিদ্যুৎ–সংযোগ পেতে দেরি করার কারণ জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক গোলাম কিবরিয়া কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, বিপুল টাকা ব্যয় করে নির্মিত ভবনগুলো খালি পড়ে থাকায় বোঝা যায় পরিকল্পনায় গলদ ছিল। এতে জবাবদিহির ঘাটতি প্রকাশ পায়।

নতুন ভবনে ওঠানোর দায়িত্ব সরকারের। সেটা করতে না পারা ব্যর্থতা। আর সরকারি কর্মকর্তারা যেসব ভবন ছেড়ে নতুন ভবনে আসবেন, সেই পুরোনো ভবনগুলোর কী হবে, সেখানেও সমন্বয়ের ঘাটতি স্পষ্ট।