সড়কের ভিড় মেট্রোতে, ইফতারের আগে ছিল ভয়াবহ অবস্থা
সোমবার ছিল নবম রোজা। এদিন বিকেলে মেট্রোরেলে অস্বাভাবিক ভিড় ছিল। একদিকে অফিস খোলা, অন্যদিকে সকাল থেকে সড়কে গণপরিবহন চলাচলে স্থবিরতা। ফলে যাত্রীদের পুরো চাপ গিয়ে পড়ে মেট্রোরেলে। বিকেলে অফিস ছুটির আগেই মতিঝিল থেকে উত্তরামুখী মেট্রোর কামরায় উপচে পড়ে মানুষ। কোনো কোনো স্টেশনে বগির ভেতরে ঠেলে ঠেলে মানুষের জায়গা করে দিচ্ছিলেন বাইরে অপেক্ষারত অন্য যাত্রীরা। এরপরও মেট্রোরেলের ভেতরে জায়গা হচ্ছিল না, বন্ধ হচ্ছিল না দরজা। তখন ঘোষণা দিয়ে দিয়ে দরজা থেকে সরে দাঁড়াতে বলা হচ্ছিল যাত্রীদের।
বেলা সাড়ে তিনটা থেকেই মতিঝিল থেকে শুরু হয় বাড়িমুখী মানুষের ঢল। মতিঝিলে অবস্থিত আইএফআইসি ব্যাংকের প্রধান শাখার একজন কর্মকর্তা বলছিলেন, ভিড়ের চাপে তাঁর কাঁধের ব্যাগের ফিতাটি ছুটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
আইএফআইসি ব্যাংকের কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তা একসঙ্গে যাতায়াত করেন। তাঁদের কাছ থেকে জানা গেল, রোজার নতুন সময়সূচি অনুযায়ী আড়াইটার সময় ব্যাংকের লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। অফিস চারটা পর্যন্ত হলেও অনেকেই রোজার জন্য বেলা তিনটা থেকে সাড়ে তিনটার মধ্যেই বের হয়ে মেট্রো স্টেশনমুখে ছুটতে শুরু করেন। চারটার মধ্যে মতিঝিল স্টেশনে চলে আসেন।
ওঠানামার যুদ্ধ
বিকেল থেকেই শুরু হয় মতিঝিল থেকে উত্তরাগামী মেট্রোতে ভয়াবহ চাপ। তাঁদের অধিকাংশই তখন বাড়ি ফিরে পরিবারের সঙ্গে ইফতার করার তাড়ায় থাকেন।
তাঁদেরই একজন বললেন, মতিঝিল থেকে আটটি স্টেশন অতিক্রম করে শেওড়াপাড়া পর্যন্ত যেতে যেতেই রোজা ধরে যায়। এই ভিড়ের কষ্ট গরমের মধ্যে বাস কিংবা গণপরিবহনে বসে অপেক্ষার চেয়ে কম নয়। তবে মেট্রোরেলে যানজট নেই এই একটা সুবিধা। ভিড়ের জন্য যত কষ্টই হোক, সেটি ৩০ মিনিটের বেশি নয়। মতিঝিল থেকে সর্বশেষ স্টপেজ উত্তরায় নামতে মেট্রোতে সর্বোচ্চ ৩৫ মিনিট সময় লাগে।
সোমবার বিকেল সাড়ে তিনটায় আগারগাঁও থেকে মেট্রোতে করে মতিঝিল যাওয়ার সময় দেখা গেল নারীদের জন্য নির্ধারিত বগিতে বারডেম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও কয়েকজন রোগী উঠেছেন, যাঁদের বাসা মিরপুরে। উল্টো দিকে যাত্রার কারণ সম্পর্কে তাঁরা বললেন, মতিঝিল থেকে উত্তরামুখী মেট্রোতে শাহবাগ স্টেশন থেকে রোগীদের জন্য ওঠা অসম্ভব। তাই বিপরীত দিকে তুলনামূলক খালি থাকে বলে তাঁরা উঠে গেছেন। মেট্রো থেকে নামতে হবে না। এই মেট্রোই ঘুরে যাবে ইউটার্ন নিয়ে। তখন একই জায়গায় বসে তাঁরা বিপরীত দিকের পথে ফিরতে পারবেন।
তাঁদের একজন সালেহা বেগম। তিনি এসেছিলেন চিকিৎসক দেখাতে। তাঁকে হুইলচেয়ারে করে এনেছেন তাঁর মেয়ে।
মেট্রোরেলে এত ভিড়ের কারণ কী
বনানীতে সড়ক দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন ঘটনা ঘিরে সোমবার সকাল থেকে কয়েক ঘণ্টা ধরে স্থবির ছিল রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বিভিন্ন উড়ালসড়কের ওপর দিয়েও হাজার হাজার মানুষ হেঁটে পৌঁছেছেন গন্তব্যে। বিকেলে সেই চাপ পুরোটাই পড়েছে মেট্রোরেলের ওপর।
মেট্রোরেলের পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, রমজান মাসে অফিস সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুন সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়েছে। মতিঝিল থেকে সকালে প্রথম ট্রেন ছাড়ে সাড়ে সাতটায়। আর সর্বশেষ ট্রেন ছাড়ছে রাত ৯টা ৪০ মিনিটে। এদিকে দিনের প্রথম মেট্রোরেল উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে সকাল ৭টা ১০ মিনিটে ছাড়ে। আর সেখান থেকে সর্বশেষ ট্রেন ছাড়ে রাত ৯টায়।
ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ সোমবার প্রথম আলোকে জানিয়েছে, অন্য সময়ে দিনে মোট ২০০টি রাউন্ড ট্রিপ থাকে মেট্রোর। কিন্তু রোজার জন্য চারটি ট্রিপ বাড়ানো হয়েছে। ফলে এখন ২০৪টি রাউন্ড ট্রিপ দেয় মেট্রো। পিক আওয়ারে ৮ মিনিট, অফ পিক আওয়ারে ১০ মিনিট বিরতি দিয়ে ট্রেন আসে।
সোমবার বিকেলে ইফতারের এক ঘণ্টা আগে মতিঝিল থেকে আবার উত্তরামুখী মেট্রোতে ফেরার সময় দেখা গেল প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষারত শত শত মানুষ, দরজায় মোটেও জায়গা নেই। তবু প্রবেশ করছে মানুষ। কোনোমতে পা দুটো রাখতে পারলেই বাড়ি ফেরার নিশ্চয়তা। মেট্রো ছাড়ার পর তিন নম্বর বগিতে বসে বোঝা গেল সচিবালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ এবং কারওয়ান বাজার স্টপেজে একজনও নামলেন না। বরং আরও কয়েকজন মানুষকে কোনোমতে ঠেলেঠুলে দেওয়া হলো। এই বগি থেকে প্রথম কয়েকজন নামলেন ফার্মগেটে। সহযাত্রী অভিযোগ করলেন মেট্রোতে নারীদের সম–অধিকার না থাকার।
মেট্রোরেলে নারী বগি বাড়ানোর দাবি
মেট্রোরেলের প্রথম বগিটি নারীদের জন্য নির্ধারিত। কিন্তু সেই বগিতে প্রচণ্ড ভিড় থাকে। বগিতে প্রবেশ করতে না পেরে পুরুষদের বগিতেই উঠতে বাধ্য হয়েছিলেন অগ্রণী ব্যাংকের মতিঝিল শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার আসমা জাহান। তিনি প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ জানিয়ে বললেন, জনসংখ্যায় নারীর সংখ্যা কম নয়। কিন্তু মেট্রোরেলে ছয়টি কামরার মাত্র একটি নারীদের জন্য। অন্তত দুটি কামরা না হলে চলে না।
আসমা জাহান জানালেন, পুরুষদের কামরায় সাধারণত কেউ বাজে আচরণ করে না, তবে নারীরা উঠলে বাড়তি সতর্কতার জন্য অনেক যাত্রী বিরক্ত হন। জানতে চান নারীদের বগিতে না উঠে কেন এখানে প্রবেশ করা হয়েছে? কিন্তু ফেরার তাড়ায় আর সড়কের স্থবির অবস্থার কাছে উপায় থাকে না কারোরই। দুর্ভোগ কমাতে নারীদের জন্য আরও অন্তত একটি বগি বাড়ানোর দাবি জানালেন তিনি।